ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় দুর্ভেদ্য খায়বর জয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:০৯ পিএম, ২৭ মে ২০২০ বুধবার

[পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। 

সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। একাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ। দ্বাদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন সাহস ও সমঝোতায় বিজয়ের বিবরণ ও মুনাফেকদের অপপ্রচারের ব্যর্থতার কাহিনী। ত্রয়োদশ পর্বে আপনারা জেনেছেন নবীজীর (স) কৌশলের কাছে কোরাইশদের পরাজয়ের বিবরণ। চতুর্দশ পর্বে আপনারা জেনেছেন হুদায়বিয়া- নবীজীর (স) অহিংস নীতির ঐতিহাসিক সাফল্যের বিবরণ। পঞ্চদশ পর্বে জেনেছেন নবীজীর বাণী নিয়ে দিকে দিকে দূতদের অকুতোভয় অভিযাত্রার বিবরণ। এবার ষোড়শ পর্বে আপনারা জানবেন- দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় খায়বর জয়ের কাহিনী।]

খায়বর। শব্দের অর্থ দুর্গ। আরবভূমিতে যথার্থ অর্থেই খায়বর ছিল ইহুদিদের দুর্ভেদ্য এক দুর্গ-মূল শক্তিকেন্দ্র। আর ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ প্রথম থেকেই। নতুন ধর্মকে তারা দেখছিল আরবে তাদের কর্তৃত্বনাশের মূল উপাদান হিসেবে। মদিনা থেকে দেড়শ কিলোমিটার উত্তরে দুর্গম উপত্যকাবেষ্টিত মরূদ্যান। উর্বর শস্যভূমি এবং মক্কা থেকে সিরিয়াগামী বাণিজ্যপথে অবস্থানের কারণে এটি পরিণত হয় সমৃদ্ধ জনপদে। তিনটি এলাকায় বিভক্ত আটটি প্রধান দুর্গ ও আরো বহু ছোট ছোট দুর্গবেষ্টিত খায়বর অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ।

মদিনা থেকে বহিষ্কৃত বনু কায়নুকা, বনু নাদির ও বনু কোরাইজার সদস্যরাও এখানে আশ্রয় নেয়ায় ইহুদি জনশক্তিও বৃদ্ধি পায় বিপুলভাবে। বিত্তবান প্রভাবশালী বনু নাদির গোত্রপতি হুয়াই ইবনে আখতাব মদিনায় মুসলিম শক্তির বিনাশে সবাইকে সমবেত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কোরাইশসহ সমগ্র আরব গোত্রগুলোকে একত্র করে মদিনা আক্রমণে পরিচালিত খন্দকের যুদ্ধ এরই ফলশ্রুতি। খন্দকের অবরোধকালে বনু কোরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে হুয়াই-এর ভূমিকাই ছিল সর্বাধিক।

খন্দকের অবরোধ সমাপ্তিতে বনু কোরাইজার আত্মসমর্পণের পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ২৫ জনের মধ্যে হুয়াই ইবনে আখতাবও ছিলেন। হুয়াই-এর মৃত্যুর পর আবু রাফে সাল্লাম বনু নাদিরের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খায়বরের ইহুদিদের সাথে মধ্য আরবের সবেচেয়ে শক্তিশালী গাতাফান গোত্রের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। গাতাফান নেতারা সবসময়ই খায়বর থেকে প্রচুর উপঢৌকন লাভ করত। খন্দকের ব্যর্থতার পর আবু রাফে সাল্লাম ইবনে আবু আল হুকায়েক গাতাফানভুক্ত গোত্রগুলোকে সঙ্ঘবদ্ধ করে খায়বরের ইহুদিদের নেতৃত্বে মদিনা আক্রমণের ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সাল্লামকে অবশ্য দুর্গে তার ঘরেই হত্যা করা হয়।

আবু রাফে সাল্লামের পর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন উসায়ের ইবনে রাজী। তিনিও পূর্বসূরিদের মতো রণ-উন্মাদনা সৃষ্টি করেন। খায়বরের ১০ হাজার সৈন্য প্রতিদিন কসরত ও মহড়ার মাধ্যমে যুদ্ধপ্রস্তুতি চালাতে থাকে। তিনি যুদ্ধে গাতাফান গোত্রের ৪০০০ সৈন্যের অংশগ্রহণের বিষয়টি পাকাপোক্ত করেন। মদিনার ওপর চূড়ান্ত আঘাতের জন্যে তারা তাদের প্রস্তুতিকে যথার্থ মনে করেন। 

এদিকে, নবীজী সবসময়ই সবার সাথে শান্তির নীতিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তি ইসলামের তিন প্রধান শত্রুর এক শক্তিকে নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় করলেও অপর দুই শক্তি ইহুদি ও গাতাফানরা আগের মতোই সক্রিয়। তিনি খায়বরে ইহুদিদের রণ-উন্মাদনাকে প্রশমিত করার জন্যে শান্তি আলোচনার উদ্দেশ্যে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার নেতৃত্বে ৩০ জন আনসারের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। আবদুল্লাহ খায়বরে এসে উসায়েরের সাথে সাক্ষাৎ করলেন।

তাকে পরিষ্কারভাবে বোঝালেন, মুসলমানরা কারো সাথেই সামরিক সংঘাত চায় না। ইহুদিরা যদি শান্তিতে বসবাস করতে চায়, তবে মুসলমানদের তরফ থেকে তাদের কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। আবদুল্লাহ উসায়েরকে মদিনায় আমন্ত্রণ জানান নবীজীর সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের জন্যে। উসায়ের রাজি হলেন। সমসংখ্যক ইহুদি যোদ্ধাসহ তিনি আবদুল্লাহর সাথে রওনা হলেন। কিন্তু কিছুদূর আসার পরই উসায়েরের মাথায় নতুন চিন্তা ঢুকে পড়ল। তিনি অকস্মাৎ আবদুল্লাহকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। আবদুল্লাহ তড়িৎ গতিতে নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করলেন। উসায়ের নিহত হলেন। ফলে ইহুদিদের সাথে শান্তি স্থাপনে নবীজীর সর্বশেষ প্রচেষ্টাও ভেস্তে গেল।

উসায়ের ইবনে রাজীর স্থলে সাল্লাম ইবনে মিশকাম খায়বরের ইহুদিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। কিন্তু তিনিও অতীতের ঘটনাবলি থেকে কোনো শিক্ষা নিলেন না। তিনিও পূর্বসূরিদের ইসলামবিদ্বেষী কর্মপন্থা অনুসরণ শুরু করলেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তির পর সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নবীজী অনুভব করলেন, খায়বরের ইহুদিদের হুমকি মোকাবেলার এখনই সময়। কারণ সূরা ফাতাহর ২৭ নং আয়াতে ভবিষ্যতে শান্তিতে ওমরাহর নিশ্চয়তা ছাড়াও আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা জানো না, আল্লাহ তা জানেন। এ-ছাড়াও তিনি তোমাদের জন্যে নিশ্চিত করেছেন আসন্ন বিজয়।’

নবীজী নতুন রণকৌশল ঠিক করলেন: এক. শুধু হুদায়বিয়ার জানবাজ সাথীদের যোদ্ধা হিসেবে সাথে নেবেন।  দুই. গাতাফানরা যাতে ইহুদিদের সাহায্যে কোনো বাহিনী পাঠাতে না পারে তার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। তাই মদিনা আক্রমণ করার কোনো সুযোগ না দিয়ে খায়বরেই তাদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে। নবীজী অভিযাত্রার প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। সূরা ফাতাহর নির্দেশনা অনুসারে অংশগ্রহণের অধিকার দিলেন শুধু হুদায়বিয়ার সঙ্গীদের।

‘হে বিশ্বাসীগণ! যখনই তোমরা এমন কোনো যুদ্ধযাত্রা করবে, যেখানে বিজয় ও যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পত্তি প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে পেছনে রেখে যাওয়া লোকজন বলবে, ‘আমাদেরও তোমাদের সাথে যেতে দাও।’ ওরা আল্লাহর নির্দেশ বদলে দিতে চায়। ওদের স্পষ্ট করে বলো, ‘তোমরা আমাদের সাথে আসবে না। (যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পত্তি কারা পাবে) আল্লাহ আগেই তা নির্ধারিত করে রেখেছেন।’ ওরা বলবে, ‘তোমরা তো আসলে আমাদের সাথে হিংসা করছ।’ আসলে ওরা সত্য খুব কমই বোঝে।’ (সূরা ফাতাহ : ১৫)

১৪০০ জনযোদ্ধার সাথে যুক্ত হলো ২০০ ঘোড়সওয়ার। মোট ১৬০০। অপরপক্ষে খায়বরের ১০ হাজার সৈন্যের সাথে যদি গাতাফানের ৪ হাজার সৈন্য যুক্ত হয়, তবে তা হবে ১৪ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী। এত বিশাল বাহিনীকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী। এক দুঃসাহসী অভিযাত্রা! প্রচলিত যুদ্ধের কোনো সেনানায়ক কখনো এমন অভিযানের সাহস করবেন না। কিন্তু অভিযানের প্রস্তুতিপর্বেও নবীজীর আত্মবিশ্বাস যে-কাউকে বিস্মিত করবে।

আনসার আউস গোত্রের আবু আবাস ইবনে জাবির নবীজীর কাছে সাহায্যের জন্যে এলেন। তিনি খুবই দরিদ্র ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের ভরণপোষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আর যুদ্ধযাত্রার জন্যে বর্ম তো দূরের কথা, কম্বল ছাড়া কোনো পোশাকও ছিল না। নবীজী তার পোশাকের ব্যবস্থা করলেন। কয়েকদিন পর তিনি দেখলেন, আবু আবাস আরো কম দামি পোশাক ও কিছু খেজুরের সাথে তার পোশাকের বিনিময় করেছে। নবীজী তাকে দেখে হাসলেন। বললেন, ‘যদি তুমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকো, তবে পরিবারের ভরণপোষণের জন্যে প্রচুর জীবনোপকরণ পাবে। আসলে তুমি ‘দিরহামে’ গড়াগড়ি করতে পারবে! তখন কেমন লাগবে তোমার!’

মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদিনা থেকে খায়বরে বার্তা পাঠানোর আগ পর্যন্ত ইহুদিরা ধারণাই করতে পারে নি যে, মুহাম্মদ খায়বর আক্রমণ করতে সাহসী হবেন। আর অভিযানের সময়সূচির ব্যাপারেও তাদের কাছে কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। তাই নবীজী মদিনা ছেড়ে বদরে এসে যেভাবে কোরাইশদের মোকাবেলা করেছিলেন, সেই একই গোপনীয়তার কৌশল অবলম্বন করলেন। তাই খায়বরের ইহুদিরা ১০ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর ১৬০০ যোদ্ধার বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

নবীজীর কৌশল ছিল খায়বরবাসীরা টের পাওয়ার আগেই পৌঁছতে হবে সেখানে। পাঁচ দিনের পথ অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিন দিনের কষ্টকর প্রয়াসে। তিনি প্রথম শিবির স্থাপন করলেন খায়বর-গাতাফান সংযোগ পথের মাঝে অবস্থিত আল-রাজী উপত্যকায়। যাতে গাতাফানরা ইহুদিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে। তিনি সেখান থেকে একটি দ্রুতগামী দল, সম্ভবত ঘোড়সওয়ারদের একটি দলকে বিকল্প পথে প্রেরণ করলেন গাতাফান জনপদের উপকণ্ঠে। গোধূলিলগ্নে তাদের শোরগোল কানে গেল গাতাফানদের। তারা মনে করল, মুহাম্মদ তাদেরকেই আক্রমণ করতে আসছে।

গাতাফানদের যে বিশাল বাহিনী ইহুদিদের সাহায্য করতে যাত্রা করেছিল, তারা ফিরে চলে গেল নিজ এলাকা রক্ষায়। কৌশলে গাতাফান বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মুহাম্মদ তৃতীয় সন্ধ্যায় হুবাব ইবনে আল মুনজিরের পরামর্শে আল নাতাহ দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে শিবির স্থাপন করলেন খায়বরের উপকণ্ঠে। খায়বরের নেতৃবৃন্দ বা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা টেরই পায় নি যে, মুসলমানরা অবরোধ আরোপের জন্যে উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। ভোরে যখন কৃষি শ্রমিকরা কাজ করার জন্যে বাগানে আসতে শুরু করল, তখন তারা মুসলিম বাহিনীকে দেখে ভয়ে-আতঙ্কে ‘মুহাম্মদের বাহিনী এসে গেছে’ বলে চিৎকার করতে করতে পড়ি কি মরি করে দুর্গে আশ্রয় নেয়ার জন্যে ছুটতে শুরু করল। মুসলমানদের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তাদের মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিল।

নবীজী সমবেতদের বললেন, ‘আল্লাহ মহান! খায়বর শেষ। তাদেরকে পূর্বেই সতর্ক করা হয়েছিল। আমরা শত্রুভূমিতে এসে পড়েছি। এখন ওদের জন্যে এটা হবে খুব অশুভ সকাল।’ কোরআনে এ প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়: ‘তবে কি ওরা আমার আজাব ত্বরান্বিত করতে চায়? ওদের আঙিনায় যখন আমার আজাব নেমে আসবে, সেই সকালটা ওদের জন্যে হবে কত না দুর্ভোগের!’ (সূরা সাফফাত : ১৭৬-১৭৭)

বিপুল সংখ্যাধিক্য ও পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও খায়বর বাহিনী কোনো সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি। তারা বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নিয়ে বিচ্ছিন্ন দল হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করে। কোরআনে এরও বিবরণ রয়েছে: ‘দুর্গ বা প্রাচীরের অভ্যন্তরে অবস্থান নেয়া ছাড়া ওরা কখনো একযোগেও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। ওদের পরস্পরের মধ্যেই প্রবল বিরোধ রয়েছে। তুমি মনে করো ওরা একজোট। আসলে ওদের মনের কোনো মিল নেই। কারণ ওরা ওদের সহজাত বিচারবুদ্ধিও প্রয়োগ করে নি।’ (সূরা হাশর : ১৪)

অপরদিকে কোরআনে নবীজীর বাহিনীর ঐক্য ও সংহতি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে: ‘(ওহুদের ময়দানে যারা নির্দেশ লঙ্ঘন করেছিল তাদের চেয়ে) যারা সারিবদ্ধভাবে সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো একাত্ম হয়ে আল্লাহর পথে লড়াই করে, আল্লাহ তাদের ভালবাসেন।’ (সূরা সাফ্‌ফ : ৪)

বিশ্বাসী জনযোদ্ধারা যাতে শত্রুর বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে চিন্তিত না হয় সেজন্যে কোরআন স্মরণ করিয়ে দিল জালুত ও দাউদের ঘটনা: ‘তারপর তালুত যখন সেনাদল নিয়ে অভিযানে বের হলো, তখন সে বলল, আল্লাহ এক নদী দিয়ে তোমাদের বিশ্বাসের পরীক্ষা করবেন। যারা নদী থেকে পানি পান করবে তারা দলচ্যুত হবে। আর যারা পানি পান থেকে বিরত থাকবে তারা আমার দলে থাকবে। অবশ্য যারা শুধু এক অঞ্জলি পানি পান করবে তারাও দলভুক্ত থাকবে। কিন্তু যখন তারা নদীর কাছে পৌঁছল তখন একটা ছোট দল ছাড়া সবাই আকণ্ঠ পানি পান করল।

যখন তালুত ও তার বাহিনী নদী পার হলো তখন আকণ্ঠ পানি পানকারীরা বলল, ‘জালুত ও তার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তি আজ আর আমাদের নেই।’ কিন্তু যারা বিশ্বাস করত যে, একদিন তাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে, তারা বলল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে একটি ছোট দল একটি বড় দলের ওপর জয়ী হয়েছে।’ নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। জালুত ও তার বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার পর বিশ্বাসীরা প্রার্থনা করল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ধৈর্য দাও, আমাদের পদক্ষেপকে সুদৃঢ় করো এবং সত্য অস্বীকারকারীদের ওপর আমাদের বিজয়ী করো।’ আল্লাহর অনুগ্রহে তারা সত্য অস্বীকারকারীদের পরাজিত করল।

দাউদ জালুতকে নিধন করল। আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিকমা দান করলেন, দান করলেন বিবিধ বিষয়ের জ্ঞান। এভাবে আল্লাহ যদি মানুষের একটি দলকে অন্য দল দিয়ে প্রতিহত না করতেন, তাহলে অনাচার পৃথিবীকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দিত। কিন্তু আল্লাহ মানুষের প্রতি অতি-অনুগ্রহশীল। (হে নবী!) এ সবই আল্লাহর বাণী, যা তোমার প্রতি নাজিল হয়েছে সত্যের নিদর্শন হিসেবে। আর তুমি নিশ্চয়ই রসুলদের একজন।’ (সূরা বাকারা : ২৪৯-২৫২)

বদর, ওহুদ ও খন্দক থেকে খায়বরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবীজীও প্রয়োগ করলেন অভিনব রণকৌশল, যা আধুনিক নগর ও জঙ্গল যুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। তিনি তাঁর বাহিনীকে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে বিভক্ত করে পৃথক পৃথক নেতৃত্বে সবগুলো দুর্গের সৈনিকদের ব্যতিব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করলেন এবং ক্রমাগত এ দলগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করতে লাগলেন। ফলে প্রতিটি দুর্গই ব্যতিব্যস্ত থাকল নিজেদের নিয়ে। আর একটি দুর্গকে বেছে নিলেন পূর্ণ অবরোধের জন্যে। 

প্রথম অবরোধ করা হলো ‘নায়েম দুর্গ’। দুর্গ থেকে ইহুদি সৈন্যরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেই পাল্টা আক্রমণের মুখে তারা ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হতো। কিন্তু মুসলমানরাও কোনোভাবেই দুর্গে প্রবেশ করতে পারল না। একেক দিন একেক সেনাপতির নেতৃত্বে আক্রমণ পরিচালিত হতো। সপ্তম দিন নবীজী আলীকে সেনাপতি মনোনয়ন করলেন। আলী তার চোখের মারাত্মক প্রদাহে সামনের সবকিছু অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন বলে জানালেন। নবীজী তখন নিজের মুখের লালা নিয়ে তা তার চোখে লাগিয়ে দেন এবং তার চোখ ভালো হয়ে যাওয়ার জন্যে দোয়া করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীর চোখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। তিনি বিপুল বিক্রমে দুর্গে আক্রমণ চালালেন। তুমুল সংঘর্ষের পর নায়েম দুর্গের পতন ঘটল। ইহুদি প্রধান সাল্লাম ইবনে মিশকাম নিহত হলেন। হারিস ইবনে আবি জয়নাব ইহুদিদের নতুন নেতা মনোনীত হলেন।

নায়েম দুর্গের পতনের পর মুসলমানরা অবরোধ করল কামুস দুর্গ। কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে কামুসের পতন ঘটল। নায়েম ও কামুস থেকে ইহুদি সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করে আস-সাব ইবনে মুয়াদ দুর্গে অবস্থান গ্রহণ করল। মুসলমানরা আস-সাব দুর্গ অবরোধ করলেন। আস-সাব দুর্গ ছিল ইহুদিদের প্রধান অস্ত্র ও খাদ্যভাণ্ডার। বিশ্বাসীদের অবরোধ ও ইহুদিদের প্রতিরোধ দুটোরই তীব্রতা বেড়ে গেল। এদিকে মুসলিম শিবিরে খাদ্যের অভাব সৃষ্টি হলো। অনেকেই এসে নবীজীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে খাবারের আবেদন করতে লাগল। তিনি তাদের আশ্বস্ত করলেন, দোয়া করলেন এবং ঘোড়া জবাই করে মাংস খাওয়ার অনুমতি দিলেন।

পরদিন ইহুদিরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে প্রচণ্ড আক্রমণ করল। কয়েক জায়গায় মুসলমানরা পেছনে হটে গেল। কিন্তু হুবাব ইবনে মুনজিরের বাহিনী নিজ অবস্থানে অটল থেকে আক্রমণ প্রতিহত করল। নবীজী সবাইকে পাল্টা আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করলেন। হুবাব ইহুদিদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করলেন। তারা দুর্গের ভেতরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মুসলমানরা প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে বাধাদানকারীদের হত্যা বা বন্দি করা শুরু করল। আস-সাব দুর্গ মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। আস-সাব দুর্গে ছিল আটা, খেজুর, মাখন, তেল, মধু ও বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর বিপুল মজুদ। মুসলমানরা তাদের শিবিরের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেল।

আসলে জনযোদ্ধাদের জন্যে সবসময় এটাই হয়ে থাকে। শত্রুর রসদ হয়ে যায় তাদের রসদ। শত্রুর অস্ত্র পরিণত হয় তাদের অস্ত্রে। পর্যাপ্ত খাদ্যসম্ভার ছাড়াও মুসলমানরা এক ইহুদি চরের সহযোগিতায় দুর্গের মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা বিপুল পরিমাণ ঢাল, বর্ম, তরবারি, তীর-ধনুকসহ ইয়েমেন থেকে আনা অনেকগুলো প্রস্তর-নিক্ষেপক যন্ত্র উদ্ধার করে। ফলে অবরোধের প্রায় মাসখানেক পরে বিশ্বাসীদের বাহিনী পর্যাপ্ত খাবার ও রসদই শুধু নয়, যুদ্ধাস্ত্রেও অবরোধ শুরুর সময় থেকেও অনেক শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যায়। পর্যাপ্ত খাবার এবং অকল্পনীয় অস্ত্রপ্রাপ্তিতে বিশ্বাসীরা নতুনভাবে অনুভব করল আল্লাহর রহমতের ছায়া।

ইহুদিরা এরপর প্রতিরোধ বুহ্যের জন্যে বেছে নিল আজ-জুবায়ের দুর্গ। মুসলমানদের তিন দিন অবরোধের কোনো প্রভাব দুর্গের ওপর পড়ল না। মুহাম্মদ (স.) একজন ইহুদি চরের কাছ থেকে দুর্গের পেছনে মাটির নিচে পাহাড়ে সুড়ঙ্গপথে ঝর্নার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার খবর পেলেন। তিনি পানির প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন করার নির্দেশ দিলেন। পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্গে পানির সঙ্কট সৃষ্টি হলো। সৈন্যদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ল। তারা মরিয়া হয়ে দুর্গের বাইরে এসে মুসলিম সৈন্যদের আক্রমণ করল। তুমুল লড়াইয়ে উভয়পক্ষের বহু হতাহতের পর মুসলমানরা বিজয়ী হলো। তারা আজ-জুবায়ের দুর্গে প্রবেশ করল। খায়বরের নাতাহ এলাকার ওপর মুসলমানদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো।

পশ্চাদপসরণরত ইহুদিরা এবার আল-শাক এলাকার শানরান পাহাড়ে অবস্থিত উবাই দুর্গে অবস্থান গ্রহণ করল। এখানে ইহুদিরা মরিয়া হয়ে লড়াইয়ে নামল। ইহুদিদের পক্ষে মাহরাবসহ বড় বড় যোদ্ধারা এখানে মুসলমানদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাল। মাহরাব নিহত হলেন মুহম্মদ ইবনে মাসলামার হাতে। দুই পক্ষে তুমুল লড়াই শুরু হলো। অকুতোভয় আবু দুজানার নেতৃত্বে ইহুদি বুহ্য ভেদ করে মুসলমানরা দুর্গে প্রবেশ করল। ইহুদিরা কোনো কালক্ষেপণ না করেই দুর্ভেদ্য আল-বারী দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করল। নবীজী ও তাঁর সঙ্গীরা আল-বারী অবরোধ করলেন।

খায়বরে ইহুদিদের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে বিবেচিত হতো আল-বারী দুর্গ। এটা বাইরে থেকে কারো পক্ষে দখল করা অসম্ভব মনে করে ইহুদিরা তাদের নারী ও শিশুদের এখানে সমবেত করে। মুসলমানদের অগ্রাভিযান রুদ্ধ করার জন্যে যা যা করা সম্ভব তার প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করল। সরাসরি সংঘর্ষে না নেমে ইহুদি তীরন্দাজরা দুর্গ থেকে তীর বর্ষণ শুরু করল। প্রচণ্ড তীর-বৃষ্টিতে মুসলমানরা দুর্গের কাছে ঘেষতে ব্যর্থ হলো। তাদের তীরের পাল্লা এতটাই ছিল যে, কয়েকটি তীর এসে নবীজীর কাপড়ে বিঁধে যায়।

অবরোধ চলতে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে তখন কোনো হতাশা বা তাড়াহুড়ো ছিল না। কারণ তখন তারা শত্রুর রসদ ও অস্ত্রে বলীয়ান। অচলাবস্থা নিরসনের জন্যে অগত্যা নবীজী ইহুদিদের কাছ থেকে হস্তগত প্রস্তর-নিক্ষেপক যন্ত্র মোতায়েন করলেন। দুর্গপ্রাচীরে প্রস্তর বর্ষণের নির্দেশ দিলেন। নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের আঘাতে দুর্গপ্রাচীর ভাঙতে শুরু করল। ইহুদি সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে নারী ও শিশুদের ফেলে রেখেই যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। দুর্গে অবস্থানরত সবাইকে বন্দি করা হলো। এর মধ্য দিয়ে সকল দুর্গসহ আল-শাক এলাকার পতন ঘটল।

পশ্চাদপসরণরত ইহুদিরা খায়বরের শেষ এলাকা আল-কুতিবাহর আল-কামুস দুর্গসহ অন্যান্য দুর্গ অবরোধ করে। আল-কামুস দুর্গে অবস্থান করছিলেন ইহুদিদের নেতা কিনানা ইবনে রাবি ইবনে আবি আল-হাকায়েক, তার পরিবার ও গোত্র। অন্যান্য ইহুদি নেতারাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। ১৪ দিনের অবরোধের পর অচলাবস্থা অবসানের জন্যে নবীজী পুনরায় প্রস্তর-নিক্ষেপক যন্ত্র সমাবেশের নির্দেশ দিলেন। তখন ইহুদিরা বুঝতে পারল, মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে জেতা যাবে না। তারা নবীজীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করল।

ইহুদিদের প্রধান কিনানা ইবনে রাবি ইবনে আবি আল-হুকায়েক দুর্গ থেকে বেরিয়ে নবীজীর কাছে এলেন খায়বরের আত্মসমর্পণের আলোচনার জন্যে। আবু বকর, ওমর, আলী ও জুবায়ের ইবনে আওয়ামের উপস্থিতিতে তিনটি শর্তে কিনানা আত্মসমর্পণ করেন: 

এক. খায়বর ছেড়ে গেলে দুর্গে অবস্থিত কোনো ইহুদিকেই হত্যা বা বন্দি করা যাবে না। যোদ্ধারা তাদের নারী, শিশু, পরিবার-পরিজনকে সাথে নিয়ে যেতে পারবে। দুই. দুর্গ ত্যাগকারী প্রত্যেকের সকল সম্পত্তির মালিক হবে বিজয়ীরা। ভূমি, সোনা, রূপা, অর্থ, ঘোড়া বা অস্ত্র কোনোকিছুর ওপরেই ইহুদিদের কোনো দাবি থাকবে না। 

দুটি শর্ত ইহুদিদের তরফ থেকেই পেশ করা হয়। নবীজী এর সাথে তৃতীয় শর্তটি যোগ করেন। শর্তটি হচ্ছে: তিন. কেউ ধনসম্পত্তি লুকানোর চেষ্টা করলে সে এই সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। তার শাস্তি হবে মৃত্যু বা দাসত্ব।

আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলো। এই দলিলের বলে খায়বরের সকল ভূসম্পত্তির মালিকানা অর্জন করল মুসলমানরা। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর যুদ্ধের সমাপ্তিতে ইহুদিরা দেশত্যাগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে নবীজীর নিকট খায়বরে বসবাস এবং কৃষি ও ফল বাগান আবাদ করার অনুমতি চাইল। তারা বলল, আমরা কৃষিকাজে আপনাদের চেয়ে দক্ষ। আমরা যদি এখানে থেকে কাজ করি, তবে কৃষিফলন অনেক ভালো হবে। তারা প্রস্তাব করল, আমরা খামারে কাজ করব। খায়বরের বার্ষিক কৃষিজ উৎপাদনের অর্ধেক আপনাদের দেবো। নবীজী তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। শান্তিচুক্তি সেভাবে সংশোধিত হলো।

শুধু নতুন একটি শর্ত যুক্ত হলো যে, মুসলমানরা যখন চাইবে, ইহুদিরা খায়বর ছেড়ে চলে যাবে। শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পর ইহুদিদের নেতা কিনানা খায়বর ত্যাগের সময় তার ধনসম্পদ লুকানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে। চুক্তির শর্ত অনুসারে তার ‘সুরক্ষা’ বাতিল হয়ে যায়। তাকে বন্দি করা হয়। নায়েমের দুর্গ দখলের যুদ্ধের সময় মাহমুদ ইবনে মাসলামা দুর্গপ্রাচীরে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এসময় দেয়ালের ওপর থেকে কিনানা একটি বড় পাথর তার ওপর ফেলেন।  পাথরটি সরাসরি মাহমুদের মাথায় পড়ে। তিনি নিহত হন। ‘সুরক্ষা’ বাতিল হওয়ায় এই হত্যার ‘রক্তপণ’ হিসেবে কিনানাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং তার পরিবারকে বন্দি করা হয়।

হুদায়বিয়ায় মুসলমানদের দৃঢ়তা ও কোরাইশদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াইয়ের বায়াতের প্রশংসায় সূরা ফাতাহতে তাদের আসন্ন বিজয় ও পর্যাপ্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছিলেন। এর দুই মাসের মধ্যেই খায়বর অভিযান পরিচালিত হয়। খায়বরের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে সোনা-রূপা ছিল না, ছিল কৃষি খামার, খেজুর ও ফল বাগান, ঘোড়া, উট, ভেড়া ও তখনকার উন্নত মানের সকল সমরাস্ত্র। খায়বরের উর্বরা ভূমিতে যে খেজুরের ফলন হতো শুধু তার বার্ষিক যাকাতের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার উটের বোঝা। নবীজী পুরো খায়বরের সম্পদ দুই ভাগে ভাগ করেন। একভাগ বায়তুল মালে রাষ্ট্র ও জনগণের ব্যবহারের জন্যে। আর দ্বিতীয় ভাগ খায়বরের যোদ্ধাদের জন্যে। দ্বিতীয় ভাগকে ১৮০০ অংশে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক যোদ্ধা একটি করে এবং প্রত্যেক ঘোড়সওয়ার একটি নিজের এবং একটি ঘোড়ার জন্যে। আবিসিনিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারীরা, যারা খায়বরে নবীজীর সাথে মিলিত হন তারাও প্রত্যেকে একটি অংশ লাভ করেন। 

প্রত্যেক জনযোদ্ধার ভাগের অংশের আর্থিক মূল্যমান আন্দাজ করা যায় একটি ঘটনা থেকে। নবীজী তাঁর এক সাহাবীকে বিয়ে দেন এক তরুণীর সাথে। বিয়ে সম্পন্ন হলেও কোনো দেনমোহর তখন ধার্য করা হয় নি। তিনিও স্ত্রীকে পরবর্তী সময়ে কোনো দেনমোহর দেন নি। যেহেতু এই সাহাবী হুদায়বিয়ায় বায়াতে ছিলেন, তাই খায়বরে তারও একটি অংশ বা শেয়ার ছিল। মৃত্যুশয্যায় তার মনে পড়ল যে, স্ত্রীকে দেনমোহর দেয়া হয় নি। তিনি সেখানে উপস্থিত সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, নবীজী আমাকে আমার স্ত্রীর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে কোনো দেনমোহর দেই নি। তোমরা সাক্ষী থাকো! আমি দেনমোহর হিসেবে খায়বরে আমার ভাগের অংশ তাকে প্রদান করছি। ওই নারী তখন তার শেয়ার এক লক্ষ দিরহামে বিক্রি করে দেন। এই হিসাবে খায়বরে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মূল্যমান হয় ৩,৬০০ X ১,০০,০০০ = ৩৬ কোটি দিরহাম। [যোদ্ধাদের ১৮০০ ভাগ + বায়তুল মালের ১৮০০ ভাগ = মোট ৩৬০০ ভাগ]

খায়বর বিজয়ের পর মদিনার অর্থনৈতিক অবস্থাই পাল্টে গেল। আনসারদের কাছ থেকে গৃহীত সাহায্য অনুদান ও উপহারের পরিবর্তে মোহাজিরদের ফিরতি উপহার প্রদানের সামর্থ্য সৃষ্টি হলো। আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের ভাষায়, আসলে খায়বর বিজয়ের আগ পর্যন্ত মদিনায় আমরা কখনো পেটপুরে খাই নি। 

নবীজী কখনো ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ চান নি। মদিনায় তিনি তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক সমমর্যাদা দান করেছিলেন। সৎ প্রতিবেশীর মতো বসবাসের সবরকম চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মদিনায় বসবাসকারী ১৭টি ইহুদি গোত্রের মধ্যে ছোট ছোট গোত্রগুলো নবীজীর নেতৃত্ব মেনে নিলেও বনু কায়নুকা, বনু নাদির, বনু কোরাইজা রাজনৈতিক কারণে পালাক্রমে চরম বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। মদিনা থেকে নির্বাসিত হয়ে এরা খায়বরে এসে সেখানকার ইহুদিদের সাথে একাট্টা হয়ে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সর্বশক্তি ব্যবহার করেছে। খন্দকে কোরাইশি অভিযানের মূল ত্রিশক্তির একশক্তি ছিল তারা। অবশ্য ইহুদিদের একটা বড় অংশ মদিনায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে। ব্যবসা বাণিজ্য করেছে। নিজ ধর্মপালন করেছে। ওহুদ ও খায়বরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। খায়বরের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে তারাও পুরস্কৃত হয়েছে।

কোরাইশরা হুদায়বিয়ায় ১০ বছরের জন্যে শান্তিচুক্তি করলেও ইহুদিরা নবীজীর শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। মুসলমানদের আক্রমণের জন্যে গাতাফান ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলোকে প্ররোচিত করেছে, তাদেরকে সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। তারা মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতিও নিয়েছে। খায়বর অবরুদ্ধ হওয়ার পর প্রতিটি দুর্গে তারা প্রবল লড়াই করেছে। মুসলিম বাহিনীকে প্রতি ইঞ্চি জায়গা দখলে প্রাণপণ লড়াই করতে হয়েছে। ইহুদিরাও বহু ক্ষেত্রে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। তাদের নিহতের সংখ্যা ৯৩ জন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত দ্রুত গতিতে নবীজীর অকস্মাৎ খায়বরে উপস্থিতি তাদেরকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়।

নবীজীর রণকৌশলের কারণে তারা নিজ নিজ দুর্গ থেকে বেরিয়ে একত্র সমবেত হতে না পারায় তারা একক কমান্ডে সর্বশক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। নবীজী আধুনিক নগর যুদ্ধের কৌশলে অল্প সৈন্যের সাহায্যেই একটা একটা করে দুর্গের এলাকার পতন ঘটান। সবশেষে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। প্রায় দুই মাসব্যাপী লড়াইয়ে মুসলমানদের পক্ষে শহিদ হন ১৫ জন। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে নবীজী তাঁর বিরুদ্ধাচারী দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তির আর্থিক, সামরিক ও রাজনৈতিক মেরুদণ্ড পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেন।

এনএস/