গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলা সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নোত্তর
কাওসার আহ্মেদ
প্রকাশিত : ০১:৩৮ পিএম, ২৮ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:০৯ পিএম, ২৮ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার
কিছুদিন পূর্বেও বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যম আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) বিচারাধীন গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলা সংক্রান্ত প্রশ্ন, প্রতিক্রিয়া এবং আলোচনা নিয়ে সরব ছিল। যেহেতু বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় প্রদান করেছে তাই এ মামলার বিষয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এখনো যথেষ্ট কৌতূহল বিদ্যমান আছে। এই প্রবন্ধটিতে উক্ত মামলা সম্পর্কিত কয়েকটি বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাব সংক্ষিপ্তাকারে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
এদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসিত হয়েছে তা হলো বাংলাদেশ কেন গণহত্যা বিষয়ক কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজে’তে মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থেকেছে? প্রতীয়মান হয় যে, আইসিজে’তে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মামলা দায়ের না করার পেছনে কৌশলগত এবং আইনগত কারণ রয়েছে। যে দুটি দেশের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে তার অন্যতম একটি হলো মিয়ানমার। সুতরাং, এটা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থেই মিয়ানমার ও তার নিজস্ব অধিবাসীদের মধ্যে বিদ্যমান কোন সমস্যা নিয়ে প্রথমোক্তের সাথে কোন বিরোধে জড়াতে ইচ্ছুক হবে না।
আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনার অত্যধিক ব্যয় অথবা ভূ-রাজনৈতিক অসুবিধার প্রশ্ন ছাড়াও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মোকদ্দমা দায়ের করা কৌশলগতভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। আবার আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, মিয়ানমারের গণহত্যা কনভেনশনের অনুপালনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনও আইনগত বিরোধও বিদ্যমান নেই। কারণ, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও দ্বিপক্ষীয় বা বহুপাক্ষিক ফোরামে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে মিয়ানমারকে দায়ী করে কখনো কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা আপত্তি উত্থাপন করে নাই। কোন সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ আইনগত বিরোধ (ডিসপুট) ব্যতিত কোনও মামলা আইসিজে’র বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপেই খারিজ হয়ে যেতে পারে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত (ইন্টারভেনশন) হতে পারবে কিনা তা অনেকেই জানতে চেয়েছেন। আইসিজে’তে বিচারাধীন মামলায় কোন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি আইসিজে সংবিধির ৬২ এবং ৬৩ অনুচ্ছেদ দ্বারা নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ যদি মনে করে যে গাম্বিয়া বনাম
মিয়ানমার মামলায় আইসিজে’র সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কোন আইনগত স্বার্থে প্রভাব ফেলতে পারে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখিত সংবিধির ৬২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে। এর জন্য বাংলাদেশকে লিখিত আবেদনপত্র এবং মৌখিক শুনানির দ্বারা আইসিজে’কে দেখাতে হবে যে উক্ত মামলার বিষয়বস্তুতে বাংলাদেশের কী আইনগত স্বার্থ নিহিত আছে এবং মামলার সম্ভাব্য ফলাফল বাংলাদেশের স্বার্থকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
অন্যদিকে, যেহেতু বাংলাদেশ গণহত্যা কনভেনশনে একটি অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র, এবং উল্লেখিত কনভেনশনের ব্যাখ্যা এই মামলার একটি ইস্যু হওয়ায় (গাম্বিয়ার প্রাথমিক আবেদনপত্রের ২৩নং অনুচ্ছেদ) বাংলাদেশ আইসিজে সংবিধির ৬৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে। শেষোক্তটির ক্ষেত্রে, আইসিজে’র রায় গাম্বিয়া এবং মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে বাধ্যতামূলক হবে। উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি মালদ্বীপ গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
আরেকটি বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন হলো যে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলায় আইসিজে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে ঘোষণা করতে এবং তাদের প্রত্যাবাসনের আদেশ দিতে পারে কিনা? মামলার প্রাথমিক আবেদনপত্রে গাম্বিয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পাশাপাশি তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারের সুরক্ষা প্রতিকার হিসাবে চেয়েছে। তবে, এগুলো গণহত্যা কনভেনশনের বিষয়বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হওয়ায় আইসিজে কর্তৃক সেগুলো মঞ্জুর করার সম্ভাবনা নেই। যেমন, সদ্য সমাপ্ত যাদব মামলায় (ভারত বনাম. পাকিস্তান), ভারত কর্তৃক চাওয়া প্রতিকারগুলির মধ্যে ছিল পাকিস্তানি সামরিক আদালত কর্তৃক কুলভূষণ যাদবের ওপর আরোপিত মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করা, অথবা পাকিস্তান যেন উক্ত সাজা কার্যকর করতে না পারে সেইমর্মে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ইত্যাদি।
আইসিজে ভারতের চাওয়া এই প্রতিকার মঞ্জুর করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল এজন্য যে আদালতের এখতিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনটির ব্যাখ্যা বা প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তা আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক কনভেনশন, ১৯৬৬ (আইসিসিপিআর) অথবা অন্যকোন আন্তর্জাতিক আইন পর্যন্ত প্রসারিত নয় [১৭ই জুলাই ২০১৯ এর রায় (মেরিটস) এর ১২৫-১২৬ এবং ১৩৫-১৩৭নং অনুচ্ছেদ।
ছবি- লেখক
আরেকটি প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজে’তে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে কিনা? প্রথমত, রাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আইসিজে’র এখতিয়ার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। আইসিজে সংবিধির ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোন রাষ্ট্র নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে আদালতের এখতিয়ারের প্রতি তার সম্মতি প্রদান করতে পারে, যথা- (১) বিবদমান রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইসিজে’র এখতিয়ার স্বীকার করে কোন বিশেষ চুক্তি বা সমঝোতা (কম্প্রোমিসরি ক্লজ) সম্পাদনের মাধ্যমে (২) কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির অন্তর্গত বিরোধ নিষ্পত্তিমূলক বিধান অনুসারে, এবং (৩) ঐচ্ছিক ঘোষণার মাধ্যমে।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গত ২৩শে নভেম্বর ২০১৭ তারিখে ‘রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন বিষয়ক সমঝোতা’ শীর্ষক একটি চুক্তি সম্পাদন করেছে। তবে, এই সমঝোতা চুক্তিতে আইসিজে’র এখতিয়ার স্বীকার করে কোনো বিরোধ নিষ্পত্তিমূলক বিধান নেই। উপরন্তু, বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কেউই আইসিজে’র এখতিয়ার স্বীকারপূর্বক কোনও ঐচ্ছিক ঘোষণা দাখিল করে নাই। অতএব, আপাতত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বা তাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে আইসিজে’তে বাংলাদেশের মামলা দায়ের করার কোন বাস্তবভিত্তিক সুযোগ নেই।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আইসিজে’তে উত্থাপন সম্ভব কিনা? এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো যে প্রত্যাবর্তন চুক্তি সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। কারণ, রোহিঙ্গাদের মতে নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া তাদের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটবে না। মিয়ানমারে প্রচলিত নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই। মিয়ানমারে তারা ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত। সুতরাং, এটা সুস্পষ্ট যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা-প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি এখন তাদের নাগরিকত্বের দাবির স্বীকৃতির ওপর বহুলাংশে নির্ভর করছে। এক্ষেত্রে, আইসিজে’র পরামর্শমূলক মতামত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে।
যদিও আইসিজে’র পরামর্শমূলক মতামত রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যকর নয় তথাপি আইসিজে কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে একটি ইতিবাচক পরামর্শমূলক মতামত বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণে সহায়তা করবে। এটি যে শুধু রোহিঙ্গাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে তাই নয়, একইসাথে মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবর্তনকেও উৎসাহিত করতে পারে। সুতরাং, এই লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ বিষয়ক পরামর্শমূলক মতামত এ-ধরণের পদক্ষেপের একটি উদাহরণ (২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
সবশেষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় কোনও দুর্বল দিক আছে কিনা? মামলাটির প্রাথমিক আবেদনপত্রের (এ্যাপ্লিকেশন ইন্সটিটিউটিং প্রসিডিংস) বক্তব্য অনুযায়ী উত্থাপিত বিরোধের অন্যতম একটি ভিত্তি হলো ১১ই অক্টোবর ২০১৯ তারিখের একটি নোট-ভারবাল, মিয়ানমার যার কোন উত্তর দেয়নি। উক্ত নোট-ভারবালটিতে গাম্বিয়া মিয়ানমারকে গণহত্যা কনভেনশনটি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিল।
পরবর্তীতে গাম্বিয়া ১১ই নভেম্বর ২০১৯ তারিখে অন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়াই বর্তমান মামলাটি দায়ের করেছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একটি আন্তর্জাতিক আইনী বিরোধ তখনই বিদ্যমান বলে মনে করা হয় যখন দুটি আন্তর্জাতিক সত্তার মধ্যে কোনও আইনগত বিষয় বা ঘটনার ক্ষেত্রে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়, অথবা আইনি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্ব বা স্বার্থের বিরোধ ঘটে (ম্যাভরোম্যাটিস ফিলিস্তিন কনসেশন মামলা)। আইসিজে’র জুরিসপ্রুডেন্স অনুসারে, কোন পক্ষ কর্তৃক আইনগত বিরোধের দাবি উত্থাপিত হলেই বিরোধের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
এক্ষেত্রে আরও দেখার বিষয় হলো যে এক পক্ষের দাবি অন্য পক্ষ সচেতনভাবে বিরোধিতা করছে কিনা (দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকা মামলা)। সুতরাং, সমূহ সম্ভাবনা আছে যে মিয়ানমার প্রাথমিক আপত্তির পর্যায়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে গাম্বিয়া কর্তৃক দায়েরকৃত মামলাটি কোনো সুস্পষ্ট বিরোধের অস্তিত্বের অভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আইসিজে’র কার্যপ্রণালী অনুযায়ী কোন মামলার এখতিয়ার (জুরিসডিকশন) বা গ্রহণযোগ্যতা (এ্যাড্মিসিবিলিটি) সম্পর্কে উত্থাপিত যে কোনও আপত্তিকে প্রাথমিক আপত্তি (প্রিলিমিনারি অবজেকশন) বলা হয় (আদালতের বিধির ৭৯, ৭৯বিস এবং ৭৯টার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী)।
পরিশেষে, এটা দেখা খুব আগ্রহের বিষয় হবে যে যদি গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমার মামলা চূড়ান্ত পর্বে যেতে সমর্থ হয় সেক্ষেত্রে গণহত্যা কনভেনশনের রিজার্ভেশন সম্পর্কিত উপদেশমূলক মতামতের আলোকে উক্ত কনভেনশনের ষষ্ঠ এবং অষ্টম অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত মিয়ানমারের রিজার্ভেশন বিষয়ে আইসিজে কী ব্যাখ্যা দেয়। এর জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে!
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এমবি//