করোনাকালে চরম সংকটে নিম্নআয়ের মানুষ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:৩৯ পিএম, ৩০ মে ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৭:৪০ পিএম, ৪ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার
চলতি বছরটা যেন সব কিছু ওলট পালট করে দিল। সব দেশ সব জাতি বিচলিত, বিপর্যস্ত। অন্ধাকার থেকে আলোর দেখা মিলছে না কিছুতেই। হয়তো মিলবে কিন্তু তা যে কবে মিলবে তার কোন সময়সীমাও জানা নেই মোড়ল দেশগুলোরও হাতে। অতি আধুনিক বিজ্ঞানও পদর্যুস্ত হচ্ছে বারবার। করোনা মহামারীতে বিশ্বের সব জাতি রাষ্ট্রই যেন নিরবে নিভৃতে দিন যাপন করছে। অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে।
এই করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছেন যারা দৈনিক মজুরি অথবা দিনে আনে দিন খাওয়া মানুষ। দেশে কোন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকলে যাদের আয়ের পথ রুন্ধ হয়ে যায় তাদের মধ্যে এক শ্রেণির হলেন- নিম্ন আয়ের মানুষ, সিএনজি চালক ও রাইড শেয়ারিং অ্যাপের রাইডাররা। এ অবরুদ্ধ সময়ে বন্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম। এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে কবে চালু হচ্ছে এ বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত আসেনি।
দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য এটাই কঠোর বাস্তবতা। ঢাকার দুই কোটি জনসংখ্যার ২০ শতাংশই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এই অবরোধে দুই মাস ধরে তাদের কোনো কাজ নেই। দিনে দিনে তারা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হচ্ছে। তারা ভিক্ষা করছেন না, কিন্তু সে পথে এগোনোর খুব বেশি বাকিও নেই। সরকারের করোনাকালীন সহায়তা বা ধনীদের আর্থিক সহায়তা কোনোটিই এই মানুষগুলোকে খুঁজে পায়নি। বেঁচে থাকার জন্য প্রাণান্তর চেষ্টায় হয়তো সম্বল ছিল সামান্য কিছু সঞ্চয় বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার-দেনা করে নেওয়া কিছু অর্থ। ৪৫ বছর বয়সী পাঠাও এর রাইডার আলামিন দৈনিক গড়ে আট শত টাকা আয় করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন। ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার জীবনে থাকা স্বাচ্ছন্দ্যটুকু জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। জীবনে নেমে আসতে থাকে ঘোর অন্ধকার। তিনি বলেন, ‘দোয়া করি, কোনো বাবা-মাকে যেন তাদের সন্তানদের অনাহারী মুখটা দেখতে না হয়।’
ওভাই রাইড শেয়ারিং অ্যাপের রাইডার মানিক বিশ্বাস। তার অবস্থাও অন্যান্য চালকদের মতো। ২৫ বছর বয়সী মানিক বিশ্বাস করেন যে দেশের সংকটময় সময় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গত দুই মাসে যে আর্থিক সংকটের মধ্যে তিনি পড়েছেন তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন এমনটি বিশ্বাস করলেও অসহায়ত্ব অনুভব করছেন তিনি। এর মধ্যে করোনাকে নিয়ে আগামীতে রাইড চালাতে গিয়ে অদৃশ্য ঝুঁকির কথাও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে খুব।
এর মধ্যে ওভাই দাঁড়িয়িছে তাদের কর্মীদের পাশে। ওভাই অ্যাপ এমজিএইচ গ্রুপের একটি সহযোগী সংস্থা। ওভাই-এর চালকদের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে চালকদের সহায়তা করা হচ্ছে। ওভাই সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশনের (সাফ) সহ-প্রতিষ্ঠাতা আনিস আহমেদের মালিকানাধীন। তার ফাউন্ডিশনটি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে গ্রামীণ অঞ্চলে ২২ হাজার পরিবারকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার করোনাকালীন সহায়তা দিয়েছে। এই চালকরা ওভাই-এর কর্মচারী নয়। তারা উবার ও পাঠাও-এর মতোই ওভাই-এর পক্ষ থেকে যাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। দেশে মহামারির মধ্যে চরম বাস্তবতা হলো নিয়োগকর্তারা তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই ঠিকভাবে বেতন দিতে পারছেন না।
এদিকে এই নিম্ন আয়ের মানুষের অংশ দেশের প্রায় ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। তাদের বেশিরভাগই সরকারি-বেসরকারি সহায়তা তালিকার বাইরে অবস্থান করছেন। ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ ও তার স্ত্রী সুহানার ‘সাফ’ নামের ফাউন্ডেশন এই সংকটের সময় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় প্রায় তিন হাজার চালক তাদের পরিবারকে এই বিপদের দিনে টিকিয়ে রাখতে পারছেন।
পরিবহন খাতে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি এ দেশে রাইড শেয়ারিং সেবার সূচনা হয়। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় উবার, দেশীয় উদ্যোগ পাঠাও, পিকমি ও সহজের মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব সম্ভাবনার আকাশে পরিবহন খাতে শৃংখলার স্বপ্ন দেখায়।
গেল সপ্তাহে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে রাইড শেয়ারিং যারা বাইকের রাইড দিতেন তাদের ১৫৭টি বাইক জব্দ করে সিলেট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিমপি)। মৌখিক চুক্তিতে তারা বাইক চালাচ্ছিলেন। মূলত কাজ না থাকায় এবং আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ায় তারায় সরকারের নির্দেশ অমান্য করে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন।
এ রাইড শেয়ারিং অ্যাপসমূক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ ও তাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে, এক লাখ চালকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে অবদান রাখা, অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তীব্র আয়-বৈষম্য কমাতে ভূমিকা রাখা, বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করা, কারিগরি ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা তথা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকরণে কাজ করে আসছিল। তবে করোনাকালে তাদের সেই অবস্থা েপুরোপুরি ভাটা পড়েছে।
বড় ধরেন এক সংকটে পড়তে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে উবারের ৬ শতাধিক কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার অ্যাপ ক্যাব সংস্থা উবার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস মহামারিজনিত কারণে প্রায় ৬০০ পূর্ণ-সময়ের কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিস্তারকে রোধ করতে ভারত লকডাউনের চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে। উবার ইন্ডিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার সভাপতি প্রদীপ পরমেশ্বরণ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ড্রাইভার এবং রাইডার সহ অন্যান্য বিভাগেও প্রায় ৬০০ জন পূর্ণ সময়ের কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই ছাঁটাই এই মাসে হওয়া বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থান হ্রাসের একটি অংশ। কোভড-১৯ এর প্রভাব এবং কবে কী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এই অনিশ্চয়তার ফলে উবার ইন্ডিয়া দক্ষিণ এশিয়ার কাছে কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই’।
গত সপ্তাহে উবার ইন্ডিয়ার মূল সংস্থা মার্কিন উবার টেকনোলজিস করোনা ভাইরাস মহামারি পরিস্থিতি সত্ত্বেও লাভজনক থাকার জন্য ২৩ শতাংশ কর্মী হ্রাস করার ঘোষণা করে। চলতি মাসের শুরুর দিকেই উবার টেকনোলজিস জানিয়েছিল যে ৬,৭০০ টি কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং অ্যাপ-ক্যাব সহ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উবার নিজের মূল ব্যবসাগুলোতে মনোনিবেশ করবে। ভারতে উবারের প্রতিদ্বন্দ্বী ওলা গত সপ্তাহেই ১,৪০০ কর্মচারি ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করে। ওলা জানিয়েছিল করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে লকডাউনের ফলে ওলার আয় ৯৫% হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে চীনে বেকার হয়ে পড়েছেন ৮ কোটি মানুষ। করোনার মহামারি চীনের অর্থনীতিকে বৃহৎ পরিসরে প্রভাবিত করে। এর ফলে সংকুচিত হয়েই চলেছে চাকরির বাজার। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির সরকারি তথ্য বেকারত্বের সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরা হয় না। প্রকৃত সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশের দেশ ভারতেরও গোটা বিশ্বের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ক্ষতির মুখে দেশটি। এ কারণে দেশটিতে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের চাকরি যেতে পারে বলে এক গবেষণায় বলা হয়েছে।
নয়াদিল্লিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ইনফরমাল সেক্টর অ্যান্ড লেবার স্টাডিজ’ বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ মেহোত্রা ও পাঞ্জাব সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক যযাতি কে পরিদার যৌথভাবে ওই গবেষণা করেন। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ গবেষণার তথ্য দিয়ে খবর প্রকাশ করা হয়েছে।
এমএস/এনএস/