ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

জাতীয় বাজেট: শিক্ষাখাতে প্রয়োজন সময় উপযোগী বরাদ্দ

মেহেদী হাসান মুরাদ

প্রকাশিত : ১০:৫৩ পিএম, ১ জুন ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১১:২৬ পিএম, ১ জুন ২০২০ সোমবার

করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিতে সংকটের মাঝেও ২০২০-২১ অর্থ-বছরের জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১২তম বাজেট। আগামী ১১ জুন প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে পেশ করা হবে। এ বাজেট সর্ম্পকে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সব কিছু মিলিয়ে ৫০তম বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

তবে এ বাজেটে রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটের তুলনায় ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। চলতি সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট খাত থেকে আদায় করা হবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা, আয়কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা এবং কাস্টমস ডিউটি থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সরকারে উন্নয়ন ও ব্যায় নির্বাহ খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি খাত হলো শিক্ষা খাত। পেছনের বাজেটে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমান বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। এ খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি অনেক দিনের। সব সময়ই এ খাতকে গুরুত্ব দিতে শিক্ষা-অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দিয়েছেন। এখনও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১০-১২ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে টাকার অংকে ও হারে বরাদ্দে আশান্বিত হওয়ার মত ও সময় উপযোগি নয়।

জাতীয় বাজেটের শিক্ষা খাতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, বরাদ্দের মধ্যে সব সময়ই মিশিয়ে দেওয়া হয় প্রযুক্তি খাতকে যা শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দকে খন্ডিত করে পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নকে ব্যহাত করে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে বাজেট বরাদ্দ ১৫.২ শতাংশ দেখালেও মূলত শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১.৭ শতাংশ। ফলে জিডিপির শতাংশ হারেও শিক্ষা খাতের বাজেট বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। এই খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরে জিডিপির ২ দশমিক ১০ শতাংশ মাত্র। ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষাবহির্ভূত খাতের বরাদ্দও আছে। শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ গত অর্থ-বছরে ছিল ৫৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা এবং ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। দেশের বিগত ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭ এবং ৪৮ তম জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে (মোট বাজেটের শতাংশ হারে): ১১.৬৬ ; ১০.৭১ ; ১৪.৩৯ ; ১২.৬০ ; ১১.৫৩ শতাংশ (সূত্র : ব্যানবেইস)। দেখা যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে মোট বাজেটের ১০-১২ শতাংশ হারে বরাদ্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও ৪৯ তম বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ১০ শতাংশ মাত্র। অথচ ইউনেস্কো এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কে (বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরকারী ও সমর্থনকারী দেশ) একটি দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থবছরের বাজেটে গুলোতে শিক্ষাখাতে এর প্রতিফলন দেখা যায় না।

নতুন প্রজন্ম এবং আমাদের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে শিক্ষায় বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি সেই বরাদ্দ কীভাবে খরচ হচ্ছে, সেটিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও আমাদের শিক্ষা পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বেতন, সম্মান ও মর্যাদা তেমন উন্নতি হয়নি। ফলে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহী নয়। প্রতি বছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে, আর এক-তৃতীয়াংশ হয় শিক্ষার উন্নয়নে। সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়বে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ। শুধু বরাদ্দের আশায় দিলেই আর হচ্ছে না, পেতে চায় ভরসা।

২০১৯ সালের একটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের মতো অবস্থানে থাকাকালে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিত শিক্ষায় যার ফলে এক সময় ওই সব দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে এলেও এখন এ দেশের শিক্ষার্থীরা ঐসব দেশে পড়তে যায়। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে এগিয়ে। সে দেশে এক সময় জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হতো শিক্ষায়। দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষা ব্যবস্থা বেসরকারি ব্যবস্থাপনা নির্ভর। এখানে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। জাতি গঠন এবং সরকারে উন্নয়নে এরা অংশীদার। অথচ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা বৈষম্য চরম। সঠিক পরিকল্পনা এবং শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় এর প্রতিকার মিলছে না। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পেশায় মেধাবীরা এই পেশায় আসতে ও থাকতে উৎসাহিত করতে এই অধিক মর্যাদাপূর্ণ বলে ঘোষণা করে যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে পদায়ন করতে হবে। শিক্ষাঙ্গণকে রাখতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রেখে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করতে হবে।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দের একাংশ যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে। এতে অনেক শিক্ষকের আর্থিক দুর্দশা ও দুরবস্থার লাঘব হয়। কিন্তু এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান ও যোগ্যতা অগ্রাধিকার পায় সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে। প্রতি অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন খাতে কতটা প্রয়োজন, তা বিবেচনা না করে একটি গতানুগতিক হারে বরাদ্দ প্রদান করা হয়। তাই বাজেটে উচ্চশিক্ষায় পৃথকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং সেই সঙ্গে সব পর্যায়ে শিক্ষার সংখ্যাবাচক সাফল্যের সঙ্গে গুণগত মানও নিশ্চিত করার জন্য টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সনদভিত্তিক শিক্ষাই নয়, কর্মদক্ষ মানবশক্তি সৃষ্টিতেও মনোযোগী হতে হবে।

বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিতপূর্বক শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাখাতে জটিলতা সৃষ্টি করছে। সর্বোপরী শিক্ষাখাতে ব্যয় একটা লাভজনক বিনিয়োগের সমতুল্য। এখানে ক্ষতি বা লোকসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানে ব্যয়ের পরিমাণ যতই বাড়বে রাষ্ট্রের ততই উন্নতি হবে।

লেখক: মেহেদী হাসান মুরাদ, শিক্ষার্থী, চূড়ান্ত বর্ষ, স্নাতক (সম্মান), প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থ সম্পাদক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস), ই-মেইল: coumahedi111@gmail.com

এমএস/এসি