ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

আমার পড়ালেখা: শৈশবের স্কুল বরিশালে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৫৬ পিএম, ৫ জুন ২০২০ শুক্রবার

রেডিও ফিনল্যান্ডের স্টুডিওতে স্বর্ণকেশী উপস্থাপিকার সঙ্গে লেখক।

রেডিও ফিনল্যান্ডের স্টুডিওতে স্বর্ণকেশী উপস্থাপিকার সঙ্গে লেখক।

খুব ছোটবেলায় কোথায় পড়েছেন? প্রশ্ন এলো আমার কাছে। ‘খুব ছোটবেলায় মানে কত ছোট বেলায়’? স্মিতমুখে শুধোই তাকে। ‘দশ বছরের কম - এই ধরুন, আপনার বয়স যখন ৮/৯’, ব্যাখ্যা করেন তিনি। আমি ভাবতে থাকি, সামনের বড় দেয়াল ঘড়িটির দিকে তাকাই, কাঁচের ফাঁক দিয়ে পাশের ঘরে যান্ত্রিক কলাকুশলীদেরকে দেখি। টের পাই, শব্দযন্ত্র পেরিয়ে সামনের বেতার উপস্থাপক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

দু’বছর আগের কথা। বসে ছিলাম হেলসিঙ্কিতে রেডিও ফিনল্যান্ডের সদ্য শুরু করা দক্ষিণ এশীয় বিভাগের স্টুডিওতে। অংশ নিচ্ছি ‘স্বল্প কথার গল্প’ অনুষ্ঠানে। বুঝতে পারছি, কথা আসলে অল্প নয়, গল্পও বেশ দীর্ঘ। চার পর্বের সাক্ষাৎকার - প্রতিটি পর্ব ৩০ মিনিটের। আলাপ করছি এক স্বর্ণকেশী বেতার উপস্থাপিকার সঙ্গে। শান্তি নিকেতনে বাংলা শিখেছেন - পরিস্কার উচ্চারণ, চমৎকার শব্দ চয়ন। ভালো লাগছে গল্প করতে। উপস্থাপিকার প্রচুর উৎসাহ নানান বিষয়ে - জেনে নিয়েছেন বহু কিছু আমার সম্পর্কে।

তাঁর প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতে কত কথা মনে পড়ল, কিছু কিছু কথা মনেই করতে পারলাম না। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বারবার স্কুল বদল হয়েছে আমার - একই শহরে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে থিতু হয়েছি বরিশাল জিলা স্কুলে। আমার অন্য ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। হয়তো আমাকে নিয়ে আমার তরুণ পিতা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে পঞ্চাশ দশকের শেষ প্রান্তে যখন আমার মায়ের দীর্ঘ সময়ের জন্য টাইফয়েড হয়, তখন আমার শিশুকালের পড়াশোনাটা গুরুত্ব পায় নি আমার পিতার মনে।

একেবারে শিশু বয়সে শিক্ষা বিষয়ে যাঁর নাম মনে আছে, তাঁর নাম শচীন মাস্টার। আমরা তখন বৈদ্যপাড়ায় একটা সাদা একতলা দালানে ছিলাম - যার মালিক ছিলেন নিভাননী বলে এক ভদ্রমহিলা। সেখানে বসার ঘরে একটি ছোট টেবিল ও দু’টো চেয়ার ছিল। শচীন মাস্টার মশায় প্রতিদিন সকালে পড়াতে আসতেন। অকৃতদার মানুষ - থাকেন জে. কে. দত্তের একতলা হলদে দালান বাড়ির উল্টোদিকে একটি দোতলা টিনের বাড়িতে। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সে বাড়িটি ছিল। শচীন বাবু আমাকে হাতে ধরে হস্তাক্ষর শিখিয়েছিলেন, মনে আছে। মুখে সব সময়ে একটা আদার টুকরো পুরে রাখতেন - তা আজও ভুলিনি।

কিছুদিন পরে বাবা যখন বিএম কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের পূর্বভবনের অধিকর্তা, তখন আমরা উঠে এলাম অধিকর্তার বাসভবনে কলেজ আঙ্গিনার মধ্যে। এখানেই আমার মা দীর্ঘদিন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন পশ্চিম ভবনের অধিকর্তা অধ্যাপক বাকের আলী। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক বাকের আলী আমাকে কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়িয়েছিলেন। তাঁর কাছে আমার আর একটি কৃতজ্ঞতার বিষয় আছে। আমার দু’বছরের কলেজ জীবনে তিনি আমাকে কলেজের ক্রিকেট খেলায় ভাষ্যকার হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমরা তখন কলকাতা বেতারে ক্রীড়া ভাষ্যকারত্রয়ী - কমল ভট্টাচার্য্য, অজয় বসু ও পুস্পেন সরকারের নামে পাগল। তাঁদের ধার করা ভাষ্যে নিজের কথার তুবড়ি ছুটিয়েছি।

এ আবাসনে আসার পরে বাবা জানালেন যে, সাহেব পাদ্রীরা বিএম স্কুলে একটি নতুন স্কুল খুলেছে - জুনিয়ার কেমব্রিজ স্কুল। সেখানে খুব ভালো পড়াশোনা হয়। সুতরাং একদিন বাবার বন্ধু ও সহকর্মী অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন আমাকে সেখানে নিয়ে ভর্তি করে দিলেন। ইংরেজীতে পড়াশোনা হয় - কিছুই বুঝি না। আমার অবস্থা তখন নীরেন চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তির’ মতোই - জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকেই বেশীরভাগ সময়ই কেটে যায়।

তবে তিনটে জিনিস পরিস্কার মনে আছে সে স্কুল বিষয়ে। এক, লিয়াকত নামে এক সহপাঠী ছিল আমার। মাথা ঠোকাঠুকির জন্য খ্যাতিমান ছিল সে। নূরুর (নূরুল আলমের) সঙ্গেও আমার পরিচয় এখানেই। সেই নূরুর সঙ্গে সখ্যতা এখনও বিদ্যমান। দুই, ওখানেই জুতোর ফিতে লাগানো, সুঁইয়ে সুতো পরানো, জামায় বোতাম লাগানো এসব শিখেছিলাম। পরবর্তী জীবনে এ বিদ্যে দিয়ে বহু প্রিয়জনের অবাক চোখের বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু যে হয়েছি, তা বলাই বাহুল্য। তিন, তাঁর মোটর সাইকেল ধরে কোন একটা জিনিস বিগড়ে দেয়ার জন্য এক পাদ্রী শিক্ষক যখন বিএম স্কুলের একটি বড় শ্রেণির শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তুলেছিলেন, তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। অতটুকু শিশুর কাছ থেকে ওই পাদ্রী শিক্ষকের হয়তো এটা অপ্রত্যাশিত ছিল, থেমে গিয়েছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। ধর্মযাজক মাত্রেই অহিংস নয়।

একদিন শুনি, বিএম কলেজের শিক্ষকেরা মিলে কলেজ অঙ্গনেই কলেজ পাড়া প্রাইমারী স্কুল বলে একটি বিদ্যালয় চালু করেছেন। প্রথমদিকে অধ্যাপকবৃন্দই ওখানে পড়াবেন। বেশ হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার! স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জুনিয়ার কেমব্রিজ স্কুল ছাড়িয়ে এখানে নিয়ে আসা হলো। আমার পিতার শ্রেণিকক্ষে তাঁর ছাত্র হওয়ার সুযোগ জীবনে ওই একবারই হয়েছিল।

সেখান থেকে কেন এবং কেমন করে শঙ্করমঠ বিদ্যালয়ে উপনীত হলাম তা আজ একেবারেই মনে নেই। শঙ্কর মঠেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েছিলাম। তার চেয়েও বড় কথা, ওই বিদ্যালয়েরই পরিস্কার স্মৃতি মনে আছে। বিস্তির্ণ জায়গা জুড়ে কি সুন্দর মঠটা। লাল মেঝে, ঘোরানো বারান্দা চারপাশে, মধ্যিখানে প্রতিমার ঘর। অজস্র গাছপালা চারপাশে। কেমন শান্ত, নীরব, সুনসান চারধার। মঠের পাশেই জীবনে প্রথম দেখেছিলাম হর্তুকির গাছ। হর্তুকি খেয়ে জল খেলে মিষ্টি লাগে - ঠিক আমলকির মতো।

বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে মঠ বাড়ি। রাস্তা থেকে নেমেই পুকুর - পাকা ঘাট। পুকুরের পাড়েই কালু ভাইয়ের বাড়ি। ওই এলাকার সব চর্মকর্মের একচ্ছত্র অধিপতি। তাঁর বড় ছেলে শঙ্কর আমাদের সমসাময়িক। পুকুর পেরিয়ে বড় একটা মাঠ। তার ডানদিকে মঠের সেবাইতের বাড়ি। বাঁদিকে শঙ্কর মঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটা বড় টানা ঘর। তাঁর মধ্যেই শ্রেণিগুলো-লাল সালুর পর্দা দিয়ে আলাদা করা। এক কোনায় জল খাওয়ার মটকা।

সহপাঠীদের মধ্যে কাশীপুরের জুরান মুখার্জ্জীর পুত্র বাবুলের কথা মনে আছে। অত দূর থেকে ও আসত। ওর এক ভাইও পড়ত আমাদের সঙ্গে যদ্দূর মনে পড়ে। ভারী মিষ্টি চেহারার লম্বা চুলের মিনুও আসত ওই কাশীপুর থেকে। বিমলকান্তি কর্মকার আসত নতুন বাজার থেকে। আগে বলি নি, এতো দিন পরে বলি। আমার লেখা ‘আমার বন্ধু বিমলকান্তি’ ওই বিমলকেই সামনে রেখে লেখা।

তিনজন শিক্ষক ছিলেন বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক টুনু সোম - অকৃতদার, যাঁকে আমরা বড় স্যার বলতাম। তিনি কলেজে আমার অংক শিক্ষক ও বাবার সহকর্মী অধ্যাপক সুখেন্দু সোমের অগ্রজ। অধ্যাপক সুখেন্দু সোম আমার দেখা অঙ্কের যাদুকরদের অন্যতম। অমূল্য বাবু ছিলেন মেজো স্যার। ছোটখাট মানুষটি - এবং সর্বদা বেত হাতে। শাস্তি দেয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো অতুল বাবুকে। তাঁকে ছোট স্যার বলতাম আমরা। ভারী স্নেহময় ছিলেন তিনি। তাঁকে কখনও কোন শিক্ষার্থীকে মারতে দেখিনি। আমরা বেশী গোলমাল করলে গলাটা একটু উঁচিয়ে টেনে টেনে বলতেন, ‘ওরে, তোরা সব জায়গায় বস।’

অতুল বাবুর পরে মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছিল। অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। লোকে তাঁকে ‘পাগলা মাস্টার’ বলতো। আমাকে দেখলেই আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতেন, ‘ঐ ঐ আমার ছাত্র’। একবার তখন আমি ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ে পড়াই। বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে বি এম কলেজে গেছি। হঠাৎ রাস্তায় তাঁকে দেখলাম - উন্মত্ত হুঙ্কারে চারদিক কাঁপিয়ে চলেছেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে। আমার ওপরে চোখ পড়তেই একেবারে শান্ত হয়ে রাস্তা পেরিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন।

দেখলাম, বুড়ো হয়ে পড়েছেন একদম। হাড় জির জিরে শরীর, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, কোটরাগত রক্তজবা চোখ। পরনে শতছিন্ন কাপড়। আমার একেবারে কাছে এসে একজন সুস্থ মানুষের মতো আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কেমন আছো? কি করছো আজকাল?’ উত্তর দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি শুনে তাঁর চোখে-মুখে বিরাট এক গর্বের আভা ছড়িয়ে পড়ল। আমার ভেতরে যে কি হলো জানি না, আমি নীচু হয়ে তাঁর পদধূলি নিলাম। চেয়ে দেখি ছোট স্যারের বড় বড় দু’চোখ টল টল করছে জলে। আমার মাথায় হাত ছোঁয়ালেন। তারপরই এক বিকট হুঙ্কার দিয়ে নামলেন পথে। ততক্ষণে আমিও চোখে ঝাপসা দেখছি।

এই পর্যন্ত বলে থামলাম ‘স্বল্প কথার গল্পে’। তাকালাম সামনে উপবিষ্ট উপস্থাপিকার দিকে। জলধারা নেমেছে তাঁর চোখেও। স্তব্ধ হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। চারদিকে ঘন এক নীরবতা, অস্বস্তিকর এক নিস্তব্ধতা, স্টুডিওর ঘড়িটার কাঁটা শব্দহীনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে বেতার কলাকুশলীরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছেন - বুঝতে পারছে না ভেতরে কি হচ্ছে। তার ভেতর থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সঙ্কেত জানালেন উপস্থাপিকাকে। সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি, হাতের অন্যপিঠে চোখ মুছলেন, তারপর খুব মৃদুস্বরে বললেন, ‘স্বল্প কথার গল্প আজ এখানেই শেষ’। তাকিয়ে দেখি, স্টুডিওর দরজার ওপরে লাল বাতি নিভে গিয়েছে, জ্বলে উঠেছে সবুজ বাতি।

লেখক- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এনএস/