নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীর পরিবারসহ করোনা জয়ের গল্প
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৩৫ এএম, ৬ জুন ২০২০ শনিবার
করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে পুরো বিশ্ব। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। প্রিয়জনকে হারানোর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে আকাশ-বাতাস। আবার করোনা ভাইরাসের এই মহামারী থেকে প্রতিনিয়ত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে হাজারো মানুষ। তেমনি আত্মবিশ্বাস, সচেতনতা,পারস্পারিক সহযোগিতায় পরিবারের ৭ জনসহ করোনা জয় করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ বর্ষের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ মোবারক হোসেন।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও কিভাবে বাসায় থেকে পরিবারসহ সকলে সুস্থ হয়েছেন এই বিষয়ে মোবারক হোসেনের সাথে কথা হয়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন একুশে টিভির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আব্দুর রহিম- মোবারক হোসেন জানায়, শুরুটা ২ মে থেকে ভাইয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার মাধ্যমে। ৪ মে ভাইয়ার টেষ্ট স্যাম্পল দিয়ে আসি। ৮মে তে ওনার খুব শ্বাসকষ্ট হয়েছিলো। ৯ মে থেকে কমতে শুরু করে। ১০ মে ভাইয়ার রিপোর্ট পজিটিভ জানতে পারি। এরই মধ্যে পরিবারের সবার করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। ১১ মে আমাদের সবার টেস্ট স্যাম্পল নেওয়া হয়। ১২ মে রিপোর্ট আসার পর জানতে পারি ভাইয়া আর ছোট বোনের নেগেটিভ আর পরিবারের বাকি ৫ জনের পজেটিভ।
প্রথমে খুব ঘাবড়ে যাই, ভেঙ্গেও পড়ি। কারণ আমার আব্বুর বয়স ৫৮+ বয়স, ডায়াবেটিস রোগী এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। আমার আম্মু ডায়াবেটিস হাইপারটেনশান এবং মেজর ব্রেইন স্ট্রোক এর রোগী, এখনো নিজের নাম মনে করতে পারেন না। ওনাদের কথা চিন্তা করে ভেবেছিলাম হয়তো এই করোনায় কি হতে যাচ্ছে পুরো পরিবারের। কিন্তু পরে ভাবলাম ভেঙ্গে পড়াই তো হেরে যাওয়া। আর অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে এইক্ষেত্রে ভয় পাওয়া মোটেও উচিত নয়। করোনা হলেই কি মারা যেতে হবে?
করোনায় মৃত্যুর পরিমান ২-১০ শতাংশ সেই তুলনায় সুস্থ হওয়ার পরিমান আরো অনেকগুন বেশি। নিজেকে শক্ত করে সবাইকে বুঝালাম। ১০দিন আগেও আমরা বাসায় যেভাবে চলতাম ঠিক ওইভাবে চলবো। দুরুত্ব বজায় রাখব না, বাসার ভিতরে মাস্ক পড়ব না কারণ সবাইতো আক্রান্ত। আর এইটা কোন সমস্যা না, প্রতিরোধ করা যায়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ-ই উত্তম। আরো অনেক কথা বলে সবাইকে বুঝালাম। তারপর আমি নিজেই সবাইকে ট্রিটমেন্ট এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু ফর্মুলা মোতাবেক কন্টিনিউ করাই। আমার একদিনের জন্য সর্দি,গলা খুসখুস কাশি ছিলো। শরীর ব্যথা ছিলো ২ দিন তবে তেমন শ্বাসকষ্ট হয়নি। ছোটভাইয়ের একদিনেই সর্দি,গলা খুসখুস ভালো হয়ে যায়। ভাবীর জ্বর আর হালকা কাশি একদিনেই কমে যায়। আব্বুর জ্বর ২দিন, কাশি ২/৩ দিন, শরীর ব্যাথা ৩/৪ দিন ছিলো। আম্মুর জ্বর মাঝে মাঝে আসতো ১০১ ডিগ্রী এর বেশী হয় নাই। গলা খুসখুস কাশি ২ দিন ছিলো, শরীর ব্যথা ১দিনেই শেষ হয়ে যায়। জ্বর ২/১ দিন পর পর আসতো, তাও ১০১ ডিগ্রীর বেশি না।
আসলে আমাদের খুব বেশী কষ্ট পেতে হয়নি। সাধারণ জ্বর,সর্দি,কাশি থেকেও নরমাল মনে হয়েছে। করোনায় সব থেকে বেশী দরকার হচ্ছে চিন্তিত না হয়ে খুব স্বাভাবিক থাকা। আক্রান্ত হবার আগে যেমন তেমন থাকা। মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখা। এটার বিকল্প নেই। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে কিংবা চিন্তা করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আমরা জানি যে ভিটামিন সি এবং জিংক বডি'স ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে এন্টিবডি প্রোডিউস করতে সাহায্য করে। তাই ক্যাভিক সি এবং জিংক বি প্রতিদিন ২ টা করে খাওয়াতাম সবাইকে।আদা খাওয়াতাম নিয়মিত। আদার যে এতভালো কার্যকারিতা আগে জানতাম না। আদা কুচি কুচি করে গরম পানির সাথে হালকা লবন দিয়ে দিনে ৫/৬ বার খাওয়া এবং গরম পানি দিয়ে গার্লিং করা, আদা চিবিয়ে খাওয়া। আদার এই ফর্মুলার ফলে ১ দিনেই আমার শুকনা কাশি, গলা খুসখুস ভাল হয়ে যায়।
করোনার আক্রান্ত হওয়ার কারণে মুখে স্বাদ এবং নাকে ঘ্রাণ থাকে না। তাই ১/২ ঘন্টা পরপর গরম পানির ভাপ নিতাম।
রঙ চা খেতাম। প্রতি ২ কাপ চা এর জন্য পানিতে ১ চা চামচ আদা বাটা, ১/২ চা চামচ লবঙ্গ বাটা, ১/৪ চা চামচ গোল করিচ বাটা, পরিমান মত এলাচি এবং তেজপাতা দিয়ে ৯ মিনিট গরম করেই পরিমান মত চা পাতা দিয়ে আরো ১মিনিট গরম করে নামিয়ে পরিমানমত চিনি অথবা মধু মিশিয়ে ৪/৫ বেলা খেয়েছিলাম সবাই। হরলিকক্স এবং দুধ ২বেলা, সিদ্ধ ডিম একটা, লেবুর শরবত, কাচা আমকে ব্লেন্ডার করে আমের শরবত প্রতিদিন একবার। মাল্টা ৩/৪ পিছ, আপেল ৩/৪ পিছ, খেজুর ৪/৫টা, কিছমিছ অল্প কিছু, কালো জিরা ১ চা চামচ প্রতিদিন খেতাম শিডিউল করে। আর ভাতের সাথে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতাম। যতটুক সহ্য করা যায় ততটুক গরম পানি খেতাম, গার্লিং করতাম,গরম পানি দিয়ে প্রতিদিন গোসল করতাম।
এইবার মেডিসিন এর হিসাব,জিম্যাক্স-৫০০ তিনবেলা। ফেনাডিন ২ বেলা ( সর্দি থাকলে) । বেশী সর্দি হলে রুপা ২ বেলা। নাপা এক্সট্রা ২ বেলা চালিয়ে গেছি যতক্ষন না শরীর সুস্থ মনে হয়েছিলো। গায়ে ব্যথা এবং শরীরের ভিতরে জ্বর অনুভুব হলে ভোল্টালিন সাপোজিটার তিনবেলা। মোনাস ১০ ( কাশি থাকলে) কাশি বেশি হলে বুকফ সিরাপ তিন বেলা। শ্বাসটান যদি হয় ডকোপা ২০০ দুই বেলা। প্রতিদিন কিছু শারীরিক ব্যায়াম বিশেষ করে ফুসফুস এর ব্যায়াম বড় করে শ্বাস নেয়া। এর ফলে ফুসফুসের এলভিওলাস বেশি প্রসারিত হয় আর ব্লাড সার্কুলেশনও বেড়ে যায়।
জীবাণু মুক্তকরণ- ব্লিচিং পাউডার এবং ডেটল দিয়ে আলাদাভাবে স্প্রেয়ার বানিয়ে প্রতি ৩/৪ ঘন্টা পর পর প্রতিটা রুম স্প্রে করতাম। ওয়াশরুমে যেই যাক সেই স্প্রেয়ার দিয়ে স্প্রে করতো। সবার রুমে আলাদা বাল্টি থাকত, বাল্টিতে ব্লিচিং পাউডার এর পানি রাখা হতো। রুম থেকে বের হলে ওই পানিতে পা এবং হাত ভিজিয়ে বের হয়ে বেসিনে সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া হতো। বাইর থেকে বাজার যা নিয়ে আসতো ডিটারজেন্টের পানিতে ভিজিয়ে রাখতাম ৫ থেকে ৮ মিনিট। এর পরে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতাম। সবার জামা কাপড় ডিটারজেন্ট এবং গরম পানিতে ধুয়ে নিতাম।
পরিশেষে বলব, করোনাকে জয় করতে আত্মবিশ্বাস এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যা আমাদের পরিবারসহ সবাইকে সুস্থ হতে অনেক বেশি সহযোগিতা করেছিলো। আমরা পরিবারসহ করোনা ভাইরাসের এই মহামারী থেকে সুস্থ হওয়ায় অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই মহান সৃষ্টিকর্তাকে এবং বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই আমার শিক্ষক,অনুজ, অগ্রজ, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব,প্রতিবেশী সবাইকে যারা আমাদের অবহেলা না করে বরং প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, খোঁজ নিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। সবার জন্য দোয়া রইল। করোনা যুদ্ধে ভয় নয়, সচেতন হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
এসি