অর্ধসত্য নাকি অসত্য?
মারুফ ইবনে মাহবুব
প্রকাশিত : ১০:১০ পিএম, ৮ জুন ২০২০ সোমবার
গল্পটা অনেকেই জানেন। পথ দিয়ে যেতে যেতে এক লোক রাস্তার পাশ থেকে একটি মুরগি পাকড়াও করেছে। উদ্দেশ্য মুরগির মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া নয়। বরং উল্টোটা। মালিক যেন টের না পায়। টের পেলেও যেন কোন অভিযোগ করতে না পারে। লোকটি মুরগি ভক্ষণকে বিধিসিদ্ধ কিভাবে করা যায় ভাবতে ভাবতে গেলেন এক জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। গিয়ে বললেন, ‘আমি একটি মুরগি পেয়েছি। কার মুরগি জানি না। কিন্তু এটা আমি খেতে চাই’। জ্ঞানী ব্যক্তি তাকে বললেন, ‘কোন একটি জনবহুল স্থানে গিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে। তিনবার ঘোষণা করার পরও কেউ যদি মুরগির বিষয়ে দাবি না তোলে তাহলে তিনি সেটি খেতে পারেন। তখন এটি খাওয়া অবৈধ নয়’। লোকটি কাছাকাছি এক বাজারে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, এই মুরগি..... তারপর খুব নীচুস্বরে বললেন, কার? যাতে ‘মুরগি’ শব্দটি সবাই শুনতে পেলেও ‘কার’ শব্দটি যেন কেউ শুনতে না পায়। এরকম তিনবার বলার পরও কেউ এগিয়ে এসে মুরগির দাবি তুললো না (সেটাই স্বাভাবিক)। তখন লোকটি মহানন্দে মুরগি নিয়ে গিয়ে উদরপূর্তি করল। সত্য বলার সময় যদি ইচ্ছাকৃতভাবে (বা অনিচ্ছাকৃতভাবে) পুরোটুকু ভালভাবে না বলি তাহলে কি তা সত্য বলা হল? যদি অর্ধসত্য বলি তাহলে কি তা সত্য বলা হল? নাকি প্রতারণা হলো?
প্রশ্নগুলো উঠছে এ কারণে যে, মানুষের সামনে কিছু তথ্য উচ্চস্বরে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং কিছু তথ্য একদম নীচুস্বরে উপস্থাপন করা হচ্ছে (কিংবা করাই হচ্ছে না)। ফলে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে। উচুস্বর আর নীচুস্বরের এইসব তথ্য দিয়ে দীর্ঘসময় ধরে মানুষকে আতিঙ্কত করে রাখা হচ্ছে। (আতঙ্ক বাড়িয়ে কার কী লাভ সেটা আপাতত এই লেখার বিবেচ্য নয়।) আর কাজটি এই করোনাকালে হয়ে চলেছে সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে।
তথ্য দিয়ে লেখাটি ভারী করা অনুচিত জেনেও কিছু তথ্য দিতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মারা গেছেন প্রায় চার লাখ মানুষ (সূত্র: ওয়ার্ল্ডওমিটার্স ডট ইনফো ৭ জুন ২০২০)। অনেকেই এটা শুনে আঁতকে উঠতে পারেন। ভাবতে পারেন, এত মানুষ মারা গেলো! নি:সন্দেহে চার লাখ একটি বড় সংখ্যা। কিন্তু কিসের অনুপাতে? সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কি সংখ্যাটি বড়? মোটেই না। আপনি যদি জানেন ৭৭৮ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ৫৩ হাজার মানুষ মারা যায় নানা কারণে। আর এ বছর এখন পর্যন্ত (৭ জুন ২০২০) মারা গেছে দুই কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। তাহলে কি এই চার লাখ সংখ্যাটিকে খুব ভয়ংকর মনে হবে? আপনি যদি জানেন- সংক্রামক নানা ব্যাধিতে (কোভিড-১৯ও সংক্রামক ব্যাধি) এ বছর ৫৬ লাখ আট হাজার মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাহলে বোঝা যাবে আসলে করোনাকালে মারা যাওয়া চার লাখ সংখ্যাটি সে তুলনায় খুব কম। বোঝা যাবে করোনাকালে মৃত্যুর অবস্থা কী আর তার আগেইবা কী ছিল।
আপনাকে যদি বলা হয়, হৃদরোগ ও স্ট্রোকে প্রতিদিন পৃথিবীতে মারা যায় ৪৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর করোনায় প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। তাহলে মৃত্যুর কোন সংখ্যাটি এবং কোন কারণটি আপনাকে বেশি আহত করবে?
বস্তুত, সত্যের পুরোটা জানলে আপনি আর ভয় পাবেন না। আতঙ্কিত হবেন না। সম্ভবত সে কারণেই পুরো সত্য প্রচার হচ্ছে না। যদি হতো তাহলে আমরা খুব সহজেই জানতাম যে, যে সময়ে করোনায় মারা গেছে চার লাখ মানুষ সেই একই সময়ে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে চার লাখেরও বেশি মানুষ, ক্যান্সারে মারা গেছে ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ছয় লাখ মানুষ এবং এইচআইভি/এইডস-এ মারা গেছে সাত লাখেরও বেশি মানুষ।
যদি আমাদের সামনে এই তথ্য তুলে ধরা হত যে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা যায় (সূত্র: কাউন্ট্রিমিটার ডট ইনফো) নানা কারণে, তাহলে করোনায় প্রতিদিন গড়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাটি (৭ জুন ২০২০ পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ জন করে মারা গেছে) কি আমাদের আতঙ্কিত করতে পারত? পারত না। কারণ তখন আমরা সহজেই বুঝতাম, (বিশ্বজুড়ে এবং দেশজুড়েও) সামগ্রিক মৃত্যুর তুলনায় করোনায় মৃত্যুর এই সংখ্যা তেমন আশঙ্কাজনক নয়।
এই সত্যগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরা হলে আমরা বুঝতাম, যত মারাত্মক বলা হচ্ছে আসলে ততটা মারাত্মক নয় করোনা। করোনার চেয়ে বড় বড় কারণ আগেও বিদ্যমান ছিল এবং এখনও বিদ্যমান আছে। তথ্যগুলো তুলনা করলেই বোঝা যায়, করোনা এমন কোন শক্তিশালী ‘মরণ ব্যাধি’ নয়। অচিরেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা দ্বারা আমরা একে পরাজিত করতে পারব। তাছাড়া, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ থেকে যে ভাইরাস সংক্রমিত হয় না - এই সত্যটি কি যথাযথভাবে সব জায়গায় প্রচার করা হয়েছে? যদি হত তাহলে কি স্বজনদের লাশ ফেলে রেখে চলে যাওয়ার মত অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটতে পারত? কিংবা লাশ দাফনে বাধা দেয়ার মত উগ্র ঘটনাগুলো?
সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু মৃত্যুর এইসব নানা ধরনের তথ্যকে তুলে না ধরে শুধু করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাকে বড় করে দেখানোর প্রবণতাকে কী বলা যায়? (আপাতত ‘প্রতারণা’ ছাড়া আর কোন শব্দ মাথায় আসছে না।) মৃত্যুর অন্যান্য কারণ এবং সেসব কারণে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যাকে একরকম আড়ালে রেখেই করোনায় মৃত্যু নিয়ে যে প্রবল প্রচার চলছে তা মানুষকে মারাত্মক আতঙ্কিত করে তুলছে। ফলে মানুষ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে- মানবিকতা, নষ্ট হচ্ছে বিবেক। কে কেন এই আতঙ্ক প্রচার শুরু করেছে, কে কেন আতঙ্ক প্রচার অব্যাহত রেখেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক তর্ক-বিতর্ক করা সম্ভব। কিন্তু তর্ক কি আমাদের মুক্তি দেবে এই আতঙ্ক থেকে? আমরা যারা আতঙ্কের শিকার (এবং ফলশ্রুতিতে অমানবিকতার শিকার) তারা যে আসলে ‘প্রচারিত’ তথ্যের দ্বারা ‘প্রতারিত’ হচ্ছি সেটা বুঝতে পারাটা এখন জরুরি।
প্রতারণা করা অপরাধ, আর প্রতারিত হওয়া তার চেয়েও বেশি অসম্মানের। সেটা বুঝতে পারলেই আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে সচেতন ও আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারব আমরা। পারব আমাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করতে। মানবিক হতে পারাটাই হবে করোনার ওপর মানুষের প্রকৃত বিজয়।
লেখক- সমাজকর্মী
এনএস/