ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

হজ না করেও হজের পুণ্য লাভ করতে পারেন যেভাবে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৩১ পিএম, ১০ জুন ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৭:০৪ পিএম, ১০ জুন ২০২০ বুধবার

করোনা ভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় এবার হজের পরিসর সীমিত করার পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব। প্রত্যেক দেশের যে নির্ধারিত কোটা আছে তার ২০ শতাংশ এবার হজে যেতে পারবেন। সেই হিসেবে প্রতিবারের তুলনায় এবার হজের পরিসর হবে ৫ ভাগের এক ভাগ।

অনেকেই আছেন, যারা এবছর হজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। অল্প অল্প করে টাকাও জমিয়ে ছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু করোনার এই সময়ে সব পরিকল্পনাই যেন আটকে গেছে। যেতে পারছেন না পবিত্র নগরীতে। এ অবস্থায় আমরা যারা হজে যেতে পারছি না, তাদের করণীয় কি?

এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনা বলা যেতে পারে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে গল্পটি তুলে ধরা হলো-

[পবিত্র হাজ আদায় শেষে ফিরতি ফ্লাইটের জন্য জেদ্দা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন এক ভদ্রলোক। নাম তার সাঈদ। তাঁর পাশের সিটে বসেছিলেন আরেকজন হাজী।

সালাম বিনিময়ের পর পাশের লোকটি বললেন, ‘আমি একজন ঠিকাদার। আল্লাহ তা’আলা আমাকে দশম হজ পালনের তাওফিক প্রদানের মাধ্যমে ধন্য করেছেন।’

সাঈদ তাঁকে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ! আল্লাহ আপনার হজ কবুল করুন এবং আপনার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন।’

লোকটি হেসে বললেন, ‘আমিন।’

এরপর লোকটি সাঈদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি এবারের আগে আর কখনো হজ করেছেন?’

সাঈদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধা করছিলেন। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করার পর বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এটি বেশ লম্বা ঘটনা এবং আমি চাইনা আমার কথা শুনতে শুনতে আপনি বিরক্ত হয়ে যান।’

লোকটি হেসে বললেন, ‘দয়া করে বলুন। আমি ঘটনাটা শুনতে চাই। তাছাড়া এখন তো আমাদের কোনো কাজও নেই। আমরা তো বসে বসে অপেক্ষাই করছি।’

সাঈদ হাসি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার গল্পের শুরুটাও অপেক্ষা দিয়েই। আমি হজের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি।’

একটি বেসরকারি হাসপাতালে ত্রিশ বছর ফিজিওথেরাপিস্ট হিসাবে কাজ করার পর আমি হাজের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

একই দিন আমি আমার বেতন আনতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর এক মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়; যার পক্ষাঘাতগ্রস্থ ছেলের চিকিৎসা আমি দীর্ঘদিন ধরে করছিলাম। আমি তাকে খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘সাঈদ ভাই! আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। এই হাসপাতালে এটাই আমাদের শেষ দেখা।’

আমি তার কথায় অবাক হলাম। ভাবলাম- তিনি হয়তো আমার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট নন; তাই ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন। আমি তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি আমাকে বললেন, ‘না সাঈদ ভাই, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি- আপনি একজন বাবার মতোই আমার ছেলের পাশে ছিলেন। আমরা যখন আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম; তখন আপনিই তার চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে আবার আমাদের মনে আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন।’

তারপর তিনি খুব দুঃখিত ও ব্যথিত মনে আমার সামনে থেকে চলে গেলেন।

এরই মধ্যে পাশের লোকটি এবার সাঈদের কথার মাঝখানে বলে ওঠলেন, ‘আশ্চর্য! তিনি যদি আপনার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হন এবং তার ছেলেরও উন্নতি হয় তবে তিনি কেন চলে গেলেন?’

সাঈদ উত্তর দিলেন, ‘আমিও এটাই ভেবেছিলাম, তাই প্রকৃত ঘটনা জানতে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিল- সম্প্রতি ছেলেটির বাবা চাকরি হারিয়েছে; এ জন্য ছেলের চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে তারা অক্ষম।’

পাশের লোকটি বললেন, ‘খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আল্লাহ ছাড়া গরিব অসহায়দের আর কেউ নেই। আপনি তাদের জন্য কিছু করেননি?’

সাঈদ বললেন, ‘আমি ম্যানেজারের কাছে গিয়ে হাসপাতালের ব্যয় খাত থেকে ছেলেটির চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তীব্রভাবে এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন- ‘এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; কোনো দাতব্য সংস্থা নয়।’

আমি সেই পরিবারের জন্য কোনো কিছু করতে না পেরে দুঃখিত হলাম। ব্যথিত মন নিয়ে ম্যানেজারের রুম ত্যাগ করলাম। তারপর হঠাৎ আমার হাত চলে গেল পকেটে; যেখানে হাজ্বের জন্য জমানো টাকাগুলো রেখেছিলাম। আমি কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর মাথা উপরে তুলে আমার রবকে বললাম, ‘হে আল্লাহ! এই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা কী তা তো আপনি ভালো করেই জানেন এবং আপনি এ-ও জানেন আপনার ঘরে গিয়ে হাজ্ব করা এবং আপনার রাসূলের মাসজিদটি স্বচক্ষে দেখার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় আর কিছুই নেই। আপনি জানেন- এই প্রিয় কাজটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমি সারাজীবন কাজ করে যাচ্ছি। একটু একটু সঞ্চয় করছি গত ত্রিশটি বছর। আপনার কসম করে বলছি- আমি এই দরিদ্র মহিলা এবং তার ছেলেকে নিজের চেয়ে বেশি পছন্দ করি। সুতরাং আমাকে আপনার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন না।’

আমি অ্যাকাউন্টস ডেস্কে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য আমার হাজের জমানো সব টাকা দিয়ে দিলাম। এতে পরবর্তী ছয় মাস তার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ হলো।

আমি হিসাবরক্ষককে অনুরোধ করলাম মহিলাটিকে জানাতে যে, এটি হাসপাতালের বিশেষ ব্যয় খাত থেকে এসেছে।

তিনি এতে আপ্লুত হয়েছিলেন এবং চোখের জল ছেড়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা আপনার এবং আপনার মতো লোকদের সবকিছুতে বরকত দান করুন।’

তাঁর পাশের লোকটি তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি আপনি আপনার সমস্ত অর্থ দান করেন, তবে হাজে গেলেন কীভাবে?’

তখন সাঈদ বললেন, ‘আজীবনের জন্য হাজের সুযোগ হারিয়ে আমি সেদিন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরে গেলাম। তবে মুহূর্তেই আমার হৃদয় খুশিতে ভরে ওঠল! কেননা আমি ভদ্রমহিলা এবং তার ছেলের একটি ঝামেলা মেটাতে পেরেছিলাম। সেই রাতে আনন্দাশ্রু নিয়ে আমি ঘুমিয়েছিলাম। গভীর ঘুমে স্বপ্নে দেখলাম- পবিত্র কাবার চারপাশে আমি তাওয়াফ করছিলাম এবং লোকেরা আমাকে সালাম দিচ্ছিল‌। তারা আমাকে বলছিল, ‘হাজ্জুন মাবরুর হে সাঈদ! কেননা আপনি পৃথিবীতে হাজ করার আগে জান্নাতে হাজ করেছেন!’

আমি সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলাম এবং অবর্ণনীয় সুখ অনুভব করলাম। আমি সমস্ত কিছুর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রশংসা করলাম এবং এই সুখানুভূতি প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি তখন আমার ফোনটিও বেজে ওঠে। দেখি আমার হাসপাতালের ম্যানেজার ফোন দিয়েছেন।

তিনি আমাকে জানান, হাসপাতালের মালিক এই বছর হাজে যেতে চান এবং তিনি তাঁর ব্যক্তিগত থেরাপিস্ট ছাড়া যেতে পারবেন না। তবে সমস্যা হলো থেরাপিস্টের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা এবং তিনি গর্ভাবস্থার শেষ দিনগুলিতে পৌঁছেছেন। তাই স্ত্রীকে এই অবস্থায় রেখে তিনি কিছুতেই যেতে পারবেন না।

এরপর তিনি আমাকে অনুনয় বিনয় করে বললেন, আপনি কি আমার একটু উপকার করবেন? আপনি কি দয়া করে মালিকের সঙ্গে হাজে যাবেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলার শোকর আদায় করে সাজদা দিলাম এবং যেমনটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন- আল্লাহ তা’আলা আমাকে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করা ছাড়াই তাঁর ঘরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।]

ঘটনাটি গল্পের মত মনে হলেও এমনটিই ঘটেছে। তাই এ ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। এই করোনার সময় দেশে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পথে বসেছেন। অনেক মানুষ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর পথযাত্রি। এমন অনেক পরিবার আছে যারা কারও কাছে হাত পাততে পারছে না কিন্তু অভাব তার ঘরে লেগে আছে। আমরা যারা অর্থবান অথবা হজের নিয়ত করেছি কিন্তু যেতে পারছি না তারা চাইলেই এমন দুর্যোগের সময় মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।

আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের ওপর হজ অবশ্য পালনীয় একটি বিধান। বস্তুত হজ্জ ইসলামি শরিয়তের অন্যতম একটি স্তম্ভ ও রুকন। তবে যাদের হজ্জে অথবা ওমরায় যাওয়ার সামর্থ্য ও সক্ষমত নেই, তাদের জন্যও দয়াবান আল্লাহ এমন কিছু পথ বের করে দিয়েছেন; যেগুলো দ্বারা দুর্বল বান্দারা মকবুল হজ্জের অথবা ওমরাহর সওয়াব পেয়ে যেতে পারে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সেসব রকমারি পথ বা আমল বাতলিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন হাদিসে।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে- মাতা-পিতার সেবা এবং তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল, আমি জিহাদে অংশগ্রহণ করতে চাই, কিন্তু আমার সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা নেই। নবীজি প্রশ্ন করলেন, তোমার মাতা-পিতার কেউ কি জীবিত আছেন? লোকটি বলল, আমার মা জীবিত। প্রত্যুত্তরে নবীজি বললেন, তাহলে মায়ের সেবা করে আল্লাহর নিকট জিহাদে যেতে না পারার অপারগতা বা ওজর পেশ কর। এভাবে যদি করতে পার এবং তোমার মা সন্তুষ্ট থাকেন তবে তুমি হজ্জ, ওমরাহ এবং জিহাদের সওয়াব পেয়ে যাবে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং মায়ের সেবা কর। (মাজমাউয যাওয়াইদ: ১৩৩৯৯) হায়সামি (রহ.) বলেন, হাদিসটি সহিহ।

আর একটি বিষয় আছে যা এই করোনার প্রেক্ষাপটে মিলে যায়। তা হচ্ছে- হাসান আল-বসরি (রহ.) বলেন, ‘তোমার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটানো তোমার বারবার হজ করার থেকে উত্তম।’

অর্থাৎ এই ভাই বলতে অন্য মানুষের উপকারের কথা বলা হয়েছে।

আমরা এটা নিশ্চই জানি যে- হজ আল্লাহ তায়ালার খুব বড় একটি হুকুম। ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের একটি। যার পক্ষে সম্ভব জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এরপর নফল হজ আরো করা যায়। ওমরা করা যায়। রমজানে ওমরা করা নবী করিম সা. এর সাথে হজ করার সমান। কিন্তু এ হজ ও ওমরা সচেতনভাবে বুঝে শুনে ক’জন করতে পারে।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের ওপর আল্লাহর হক এই যে, তাদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন আমার ঘরে আসে।’

প্রিয় নবী সা. বলেছেন, ‘কবুল হজ মানুষকে এমন করে দেয়, যেমন সে মায়ের পেট থেকে নিষ্পাপ হয়ে জন্মেছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা এর মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ।’

অপর হাদিসে তিনি এও বলেছেন, ‘সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি হজ করল না, সে ইহুদি হয়ে মরুক বা নাসারা হয়ে মরুক (এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই)।’ -আল হাদিস।

তবে নিষ্পাপ নবজাতকের মতো হওয়ার জন্য ইসলাম বহু পথ খোলা রেখেছে। সবসময় তাওবা ইস্তেগফার করা, এক জুমা থেকে আরেক জুমা মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ, রমজানের রোজা ও তারাবি, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ইত্যাদিও গুনাহ মুক্তির পথ।

এছাড়া আরও একটি পথ রয়েছে সেটি হচ্ছে- একজন রোগী দেখতে গেলে দু’টি হজ, দু’টি ওমরা ও একজন কৃতদাস মুক্ত করার সওয়াব পাওয়া যায়। এটি হাদিসের কথা। যা উপরোক্ত ঘটনার সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। অর্থাৎ অভাবগ্রস্থ ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে পারলে আল্লাহ তায়ালা চাইলে হজের চেয়েও বেশি সওয়াব দান করতে পারেন। 

এসএ/