ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

করোনা: বাড়িতে বসে চিকিৎসা নেয়াই সমীচীন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৪৫ পিএম, ১১ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার

করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে এই মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। আমাদের সরকারও দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে এবং অধিকাংশ এলাকায় লকডাউন জারি করেছে। লক্ষ্য হলো- এই সময়ের মধ্যে দেশে যেসব ভাইরাস আক্রান্ত রোগী আছে, তাদের শরীর হতে ভাইরাসগুলো নির্মূল হয়ে যাবে এবং সামাজিক সংক্রমণও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এক সময় দেশ করোনামুক্ত হবে। এ লক্ষ্যে আমরা সবাই  সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম-বিধিগুলো মেনে চললে এই মহামারীর ঊর্ধ্বগতির লাগামটি টেনে ধরে নামাতে পারবো। 

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসটির সংক্রমণের পথ এবং বিস্তার বিবেচনা করে এর সংক্রমণ রোধের জন্য বিভিন্ন গাইডলাইন তৈরী করেছেন। এ গাইডলাইনে সংক্রমণ রোধে আগের উপদেশমালা মেনে চলার সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব কমপক্ষে ৩ ফিট বজায় রেখে চলার উপরে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আইয়ূব আল মামুন বলেন, কমপক্ষে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকলে শরীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে ভাইরাসটি পরাস্ত হয়ে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। ফলে সে করোনামুক্ত হয়ে যায় এবং ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া কোয়ারেন্টাইন সময়ে সে পৃথক বা আলাদা থাকে বিধায় ভাইরাসটিও ছড়ায় না। আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে আক্রান্ত ব্যক্তি হতে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনাও কমে যায়।
 
তিনি বলেন, এই নিয়ম-কানুনগুলো আক্রান্ত রোগী, সংক্রামক উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সুস্থ ব্যক্তি- সবারই মেনে চলা আবশ্যক। কেননা, সুস্থ ব্যক্তি জানেনা সে নিজে ভাইরাসটি বহন করছে কিনা, তাই সে নিজের অজ্ঞাতেই অন্যকে সংক্রামিত করতে পারে অথবা নিজে সংক্রমিত হতে পারে।

এই সহযোগী অধ্যাপকের মতে, উপরোক্ত নিয়মকানুনগুলো মেনে চলা খুব একটা কষ্টসাধ্য কাজ নয়। প্রয়োজন প্রতিটি ব্যক্তির সচেতন আচরণ এবং এভাবে সমাজের সকল ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করে কর্মসূচিগুলো পালন করা। এইভাবে প্রতিজন এবং সমাজের সকল ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে উপরোক্ত নিয়মগুলো বিশেষ করে কোয়ারেন্টাইন কর্মসূচী যথারীতি পালন করলে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চললে ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করা সম্ভব। কোন একজনের একক প্রচেষ্টায় এর কোন সুফল আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন সকলেরই সচেতন এবং দায়িত্ববোধ সহকারে প্রতিটি কর্মসূচী পালন করা। এই সচেতনতা জাগ্রত করতে ও যথাযথ নিয়ম পালনের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে গণমাধ্যমগুলো প্রচারণার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারে।

হোম কোয়ারেন্টাইন-এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে ডাঃ মোঃ আইয়ূব আল মামুন বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে সারা বিশ্বে হোম কোয়ারেন্টাইন-এর ওপরে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশে জরুরী আইন, কারফিউ, লকডাউন, সরকারি ছুটি ইত্যাদি ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো- প্রতিটি বাড়ির প্রতি জনকে ঘরের মধ্যে পারিবারিক পরিবেশে ঘরোয়াভাবে থেকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। বৃহৎ আকারে সমাজের প্রতিটি লোককে সংযুক্ত করা যায় বলে এটি ভাইরাস সংক্রমণ রোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। এখানে ভাইরাস আক্রান্ত কেউ নির্ধারিত সময়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকলে সে আপনা আপনি সেরে যায় ও তার শরীরের ভিতরের ভাইরাসগুলো ধ্বংস হয়ে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। ঘরের ভিতরে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় পরিবারের অন্যদের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। 

তিনি বলেন, এখানে নিয়ম হলো- প্রত্যেকে আলাদা কক্ষ ব্যবহার করা এবং আলাদা বাথরুম ব্যবহার করা। কোন বাড়িতে লোকজন বেশি থাকলে খাট, মেঝে, বারান্দা মিলে তিন ফুট দূরে দূরে থাকলে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও মিটে যায় এবং সম্ভব হলে আক্রান্ত ব্যক্তি সবার পরে টয়লেট ব্যবহার করবে এবং ব্যবহার শেষে প্রচুর পানি ঢালবে ও ডিটারজেন্ট ব্যবহার করবে। বাড়ির বয়স্ক ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থ লোকদের দিকে বেশি নজর রাখা উচিত। কেউ বেশি অসুস্থ হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারে এবং সেখানে কোয়ারেন্টাইনে যেতে পারে এবং প্রয়োজনবোধে অন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিতে পারে। বিশেষ করে যারা সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছে অথবা তার সংস্পর্শে এসেছে অথবা দেশের ভিতরে এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় চলাচল করেছে তাদের স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া উচিৎ। 

বিএসএমএমইউ-এর এই চিকিৎসক বলেন, দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিজন আক্রান্ত রোগীকে ভাইরাসমুক্ত করতে এবং সংক্রমণ রোধে একসঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সুযোগ করে দেয় বিধায় হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টি অনেক গুরুত্ব বহন করে। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় অফিসিয়াল কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া যেমন- টেলিফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ও জরুরী অফিসিয়াল কাজগুলো করতে পারে। একান্ত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া পরিহার করা উচিৎ, কোন বিশেষ কারণে বাইরে গেলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসায় প্রবেশ করবে। 

মনে রাখতে হবে, হোম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া কোন লজ্জার বিষয় নয় বা সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়ার কিছু নয় বা এটিকে জেলে আবদ্ধ থাকার মতো মনে করার বিষয় নয়। এখানে নিজে যেমন সুস্থ হওয়া যায়, তেমনি নিজের আপন জন তথা দেশবাসীকে সুস্থ রাখার সুযোগ করে দেওয়া যায়। বিপরীতক্রমে হোম কোয়ারেন্টাইনে কেউ অন্যথা করলে পরিণতিতে সে যেমন নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়, তেমনি মনে হয় সে যেন নিজের অজান্তে নিজের কাউকে হত্যার মানষে শাণিত তলোয়ার উন্মোচণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিৎ হোম কোয়ারেন্টাইনের কর্মসূচী যথাযথভাবে পালন করে নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া। যা এই মুহূর্তে জাতির একটি চরম প্রত্যাশা। আর এটা বাস্তবায়নের সফলতার উপরে পুরো সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার সাফল্য নির্ভর করছে। 

সেই সাথে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকলে শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরাস্ত করে নিস্ক্রিয় করে দেয়। তাই আতঙ্কিত না হয়ে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে সুষম খাদ্য (প্রোটিন, ভিটামিন, ফলমূল) গ্রহণ করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সতেজ রাখার ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগী মাইলড গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। মানে তাদের মৃদু ধরনের উপসর্গ হচ্ছে আর তেমন বড় কোনো জটিলতা ছাড়াই সেরে উঠছেন। খুব কম রোগীরই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন। করোনায় আক্রান্ত হলে বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। 

তিনি বলেন, বেশির ভাগ করোনা রোগীর চিকিৎসা বাড়িতেই খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। বরং হাসপাতালে স্বজনদের ছাড়া একাকী অনেকেই অসহায় আর অনিরাপদ বোধ করেন। পজিটিভ রিপোর্ট এলে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে একটি চিকিৎসা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরামর্শ নিতে হবে। যাঁদের অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, শ্বাসকষ্ট বা বুকে চাপ অনুভব করছেন না, গুরুতর কোনো শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করছেন না, তাঁরা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে বাড়িতে অন্যদের থেকে রোগীর আলাদা থাকা জরুরি। আলো-বাতাসে ভরা একটি ঘরে তিনি নিজেই নিজের যত্ন নেবেন (সম্ভব হলে), অর্থাৎ তাঁর সংস্পর্শে অন্যরা যত কম যাবেন ততই ভালো। যাঁদের বাসা ছোট বা একসঙ্গে অনেক মানুষের বসবাস তাঁরা আইসোলেশন সেন্টারে যেতে পারেন বা ঘরের এক কোণে যেদিকে জানালা আছে সেখানে পর্দা দিয়ে আলাদা থাকবেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে হাঁচি-কাশির আদবকেতা মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে (হাঁচি-কাশি বা কথা বলার সময় যাতে পরিবেশে খুব বেশি ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে), বারবার হাত ধুতে হবে। এভাবে পরিবারের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। কোনো মা যদি আক্রান্ত হন, যিনি সন্তানকে বুকের দুধ দিচ্ছেন, তিনি মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন।

তবে বাসায় অবস্থানকালীন শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ বা বড় রকমের কোনো অস্বস্তি হলে এবং দিনে দিনে কাশি বেড়ে গেলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিতে হবে উল্লেখ করে ডা. রুবীনা ইয়াসমীন বলেন, করোনা রোগীকে আলাদা ঘরে রাখলেও সবার উচিত বারবার তার প্রতি খেয়াল রাখা। দরকার হলে ফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা। বাড়ির লোকেরা যদি দেখেন যে তাঁর চৈতন্য কমে যাচ্ছে, জ্ঞানের মাত্রার তারতম্য হচ্ছে, কিছুই খেতে পারছেন না বা অনেক বমি বা ডায়রিয়া হচ্ছে তাহলেও হাসপাতালে নিন। সম্ভব হলে বাড়িতে একটি পালস অক্সিমিটার রাখতে পারেন, যা দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে এলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

তিনি বলেন, বাড়ির লোকেরা, পারতপক্ষে রোগীর ৩ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে যাবেন না। তবে তার প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে হবে। রোগীর ঘর নিয়ম মেনে জীবাণুমুক্ত করা উচিত। রোগীকে খাবার দেওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতে হবে। রোগীর ঘরে প্রবেশের সময় মাস্ক পরতে হবে এবং বের হয়ে তা ফেলে দিয়ে হাত ধুতে হবে। আর এভাবেই ধৈর্য্য সহকারে পরাজিত করতে হবে মহামারী করোনাকে।

এনএস/