সন্তান সম্ভাবা দম্পতির করোনা জয়-১
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ১০:১৪ পিএম, ১১ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার
সস্ত্রীক লেখক
সন্তান সম্ভাবা প্রতিটি নারী-ই স্বপ্ন দেখে তার সন্তান যেন সুস্থভাবে ধরনীতে আসে। মাতৃত্ব নারী জীবন সার্থক করে সংসারকে আনন্দে ভরে তোলে। তাই প্রত্যেক নারী গর্ভধারণের প্রথম থেকেই মনের গহিনে বুনতে থাকে এমন শত আয়োজন ও ভালো লাগার বিষয়। কিন্তু অকস্মাৎ যদি কোন ঘটনা প্রথমবার সন্তান সম্ভাবা কোন নারীর স্বপ্ন ফিঁকে করে দেয়; তবে সে তো আর স্বাভাবিক চিত্তে থাকতে পারে না। যদি কোন মরণঘাতী রোগ স্বামী ও অনাগত সন্তানসহ তার জীবন কেড়ে নেওয়ার উপক্রম করে। তবে সে তো আর জ্ঞান শক্তি ধরে রাখতে পারে না।
এমনি এক নিদারুণ ঘটনা ঘটে আমার জীবনে। সেদিন আমার স্ত্রী দু’পা জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিল। তার কান্নায় যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসছিল। আমার সব ইন্দ্রিয় যেন অকেজো হয়ে যাচ্ছিল। শান্তনা দেয়ার ভাষা সেদিন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেননা, সে সেদিন বুক ফাটা আর্তনাদ করছিল আর শুধু একটি প্রশ্নই করছিল- ‘আমার বাবু (সন্তান) কী আর দুনিয়ায় আসতে পারবে না?’ আমরা কী এমন অপরাধ করেছি আল্লাহর কাছে? যে তিনি আমাদের তিনজনের প্রাণ কেড়ে নিবেন। ও আল্লাহ! তুমি আমাদের অনাগত নিষ্পাপ বাবুর জন্য হলেও আমার ও আমার স্বামীকে সুস্থ করে দাও।
দিনটি ছিল ১১ মে, সোমবার। প্রতিদিনের মতো এদিনও বাসায় বসে অফিসের কাজ করছিলাম। তবে এদিন প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম নিয়ে কাজ করছিলাম। কারণ গায়ে জ্বর আর ব্যথা ক্রমশই বাড়ছিল। যদিও শরীরের এ জ্বর আরো তিনদিন আগে থেকেই ছিল। প্রথম তিনদিন এটাকে পাত্তাই দেয়নি। সিজনাল জ্বর হিসেবেই দেখছিলাম। তাই সামান্য সেই জ্বর-ব্যথা সারতে ভরসা করেছিলাম শুধু নাপা-তেই।
আমার সহধর্মিণী কয়েকবার করোনা ভাইরাসের প্রসঙ্গ উঠালেও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলাম। আর নিজে তো একবারও করোনার কথা কল্পনাতেও আনি নাই। কিন্তু তার জোরাজুরি আর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র করোনা টেস্টের বিশেষ সুযোগ থাকায় আগের দিনে ১০ মে স্যাম্পল দিয়ে আসছিলাম। স্যাম্পল দিয়ে আসলেও আমি কিন্তু ছিলাম স্বাভাবিক। কোন আতঙ্ক বা টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার উদ্বিগ্নতা মোটেও ছিল না।
তবে স্যাম্পল দেয়ার পরদিন ১১ মে বন্ধু আবু আলী ফোনে রেজাল্ট জানতে চেয়েছিল। আমি বললাম রেজাল্ট আসেনি। ও বললো, আরে করোনা হলে এতোক্ষণে ক্যালাই (অসুস্থ হয়ে) পড়তে। আমি বললাম আমিও তাই মনে করছি বন্ধু। আসলে এটি আবহাওয়ার কারণে হয়েছে। কথা সেখানেই শেষ।
শরীরটা ক্লান্ত ভেবে আমি শুয়ে আছি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ভাত খেতে বসবো। এমন সময় ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের নেতা রাজি হাসানের ফোন। সে জানায়, ভাই আপনার টেস্ট রেজাল্ট মেইলে পাঠানো হয়েছে। দেখেন তো, কী রেজাল্ট আসছে। আমি খাওয়া বাদ দিয়ে মুহূর্তেই মেইল ওপেন করি। মেইলে করোনা টেস্টের রিপোর্টের দিকে আমার আগেই স্ত্রীর চোখ পড়ে। আমার আগেই সে বুঝে ফেলে যে তার স্বামীর করোনা পজিটিভ। এক সঙ্গে বসবাস করায় তার শরীরেও এতোদিনে করোনা ভাইরাস ভর করেছে নিশ্চিত। যা তার ও তার স্বামীর প্রাণ কেড়ে নিবে। দুনিয়ায় আসতে দিবে না তাদের অনাগত সন্তানকে।
এই ভয়েই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে আর যেন শেষ বারের মতো স্বামীকে স্পর্শ করতে থাকে। নিজের পেটে হাত দিয়ে বলতে থাকে বাবুটা আমার, অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন ও আয়োজন ছিল তোমাকে ঘিরে। কিন্তু বিধাতা আমাদের উপর নাখোশ। তুমি পৃথিবীর আলো আর দেখতে পারবে না।
ঘরের চার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয় সে। বলতে থাকে, কতো কষ্ট করে গুছিয়েছি এ সংসার। আমার স্বামীর কোন বদ অভ্যাস নেই। দুজনের চিন্তায় কতো মিল। সবাই আমাদের আদর্শ ও সুখী দম্পতি বলে। আজ আমার সুখের সংসার। আল্লাহ! আমার সে সুখ সইলো না। স্ত্রীর কান্নার সঙ্গে গুমরে গুমরে কেঁদেছি আমিও। কিন্তু স্ত্রীকে বুঝতে দেয়নি। সে আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে বলে।
এভাবে কাঁদতে কাঁদতেই কোন কিছু খাওয়া ছাড়াই চলে যায় একটি দিন। শুধু মনে হচ্ছিল, মরতে তো হবেই- কী হবে খেয়ে। আর ঘুমের কথা ভুলে ছিলাম পুরো দুটো দিন। দুইদিন পর বুঝতে পারি, চোখে ঘুম জমেছে। ঘুমের দরকার। কিছু খাওয়াও দরকার। না খেলে তো বেঁচে থেকেই মরে যাচ্ছি!
এভাবে দুইদিন পর বন্ধু ও শুভাকাঙ্খীদের যোগানো সাহসে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকলাম। সঙ্গে চলতে থাকলো প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য। দীর্ঘ এক মাসের যুদ্ধের পর নিজেকে সুস্থ হিসেবে দেখলাম। যদিও এখনও অনেক দুর্বল। শরীরের গিট ও শীরাগুলোতে ব্যথা। চোখেও ব্যথা। উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে।
তবে কীভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম? কেমন কাটছিল অসুস্থ সেই দিনগুলো? এসব বিষয়গুলো পরবর্তী লেখায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ইনশাআল্লাহ।
লেখক- সাংবাদিক।
এনএস/