করোনায় জয়ী হওয়ার প্রার্থনা ও ব্রতী
কার্ত্তিক চন্দ্র দাস
প্রকাশিত : ০২:৪৩ পিএম, ১৫ জুন ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৯:১৬ পিএম, ১৫ জুন ২০২০ সোমবার
ছবি: প্রতীকী
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বিখ্যাত কবিতা- বিপদে মোরে রক্ষা করো। কবিতায় কবি লিখেছেন- বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দু:খতাপে ব্যথিত চিতে, নাই বা দিলে সান্ত্বনা, দু:খে যেন করিতে পারি জয়। করোনাকালে এর চেয়ে ভালো প্রার্থনা আর হতে পারে না। পৃথিবীর সব মানুষ শুধু পরম প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে পারি তিনি আমাদের করোনা জয় করার শক্তি দেন। আমরা জানি, বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোনো কিছুই হাঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, বা অপ্রয়োজনে সৃষ্টি হয়নি সবকিছুরই একজন স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা আছেন। তাকে কেউ বলে ভগবান, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে গড। হিন্দুধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে বলে ভগবান। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর সবকিছুই ঈশ্বর বা স্রষ্টার সৃষ্টি। কেবল পৃথিবী নয়, পৃথিবীর বাইরেও যা কিছু আছে সব কিছুর স্রষ্টা তিনি। ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিপালন করেছেন।
আমরা বিশ্বাস করি মানুষসহ সকল জীবের মধ্যে সৃষ্টির মধ্যেই ঈশ্বর অবস্থান করেন। ভালোবাসব ঈশ্বরের সকল সৃষ্টিকে। কারণ ঈশ্বরের সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসা মানে ঈশ্বরকে ভালোবাসা। সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হবেন এবং মঙ্গল করবেন। তাই আসুন, ভয়হীন থাকি ও স্রষ্টার সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসি। পৃথিবীর সকল সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রতিটি প্রাণী প্রতিটি বস্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন বাতাস না থাকলে আমরা বাঁচতে পারব না, অথচ আমরা বিভিন্নভাবে বাতাস দূষিত করেছি। বাতাসের যে প্রাণ আছে আমরা সেটা ভুলে আছি। পানি বা নদী না থাকলে আমরা বাঁচতে পারবো না। অথচ আমরা নদী দখল দূষণ করেছি ইচ্ছামতো। তারপরে চারপাশে, কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, পিঁপড়া, ব্যঙ সবকিছুই আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। অথচ এদের জন্য আমাদের হৃদয়ে কোন ভালোবাসা নেই। আমরা যদি দেখি একজন স্রষ্টা পৃথিবীর মানুষসহ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। নদীনালা, বাতাস, গাছ, পশু-পাখিসহ সবকিছু। তিনি তার নিজস্ব নিয়মে সবকিছু লালনও করেন। মানুষ ছাড়া স্রষ্টার সৃষ্টির কেউই এত শক্তিশালী নয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু অন্য সৃষ্টির চেয়েও মানুষ একাই বেশিই ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর সবকিছু লালন করার ক্ষমতার পাশাপাশি ধ্বংসের ক্ষমতাও সে রাখে। স্রষ্টা তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছে বলেই সে অর্জন করেছিল। কিন্তু এখন কী নির্মম বিষয়, ক্ষমতাবান মানুষ একেবারেই অসহায়। সৃষ্টির সবকিছু সতেজে হচ্ছে, আর সে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে।
একটি অন্যতম কাহিনী বর্ণিত হয়েছে প্রাচীন ভারতের উপনিষদে। দেবতারা একবার অসুরদের যুদ্ধে হারিয়েছিলেন এবং সেই হেতু তাদের অহংকারের সীমা পরিসীমা ছিল না। তারা ভেবেছিলেন এই জয় সম্পূর্ণ তাদেরই কৃতিত্ব। তাদের মনে হয়েছিল তাদের শক্তি ও ক্ষমতার বলেই তারা অসুরদের পরাজিত করতে পেরেছিলেন। পরাব্রহ্ম ভাবলেন তাদের অহংকার চূর্ণ করবেন। তিনি একজন পঙ্গু, বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে দেবতাদের কাছে এলেন। দেবতারা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি চান?’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমি কিছুই চাই না। আপনারা কি প্রসঙ্গে এত গর্ব করছেন তাই শুধু জানতে চাই।’
তারা বললেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে অসুরদের সঙ্গে শক্তির দ্বারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। তাই আমরা আনন্দ করছি।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘বেশ আমার একটি উপকার করুন। আমি আপনাদের ঠিক সামনে এক টুকরো খড় রেখে যাচ্ছি। আমার ইচ্ছে আপনাদের মধ্যে কেউ একজন এটিকে উড়িয়ে দিন অথবা কিছু একটা করুন। পবনদেবতা এসে সেটিকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন কিন্তু সেটি এক বিন্দু নড়ল না। তখন অগ্নিদেবতা এসে সেটিকে পুড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অনল তাকে গ্রাস করতে পারল না। এই ভাবে তা চলতেই লাগল।
অবশেষে এলেন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। যখন তিনি এলেন তখন সেই বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়েছেন ও তার স্থানে এক আলোক স্তম্ভের ভিতর এক দেবী আবির্ভূত হলেন। ইন্দ্র সেই দেবীর কাছে জানতে চাইলেন, কে এই পরমাশ্চর্য্য বৃদ্ধ। দেবী বললেন, ‘ইনি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নন। ইনি হলেন স্বয়ং পরব্রহ্ম যিনি সত্য কী তা আপনাদের জানাতে চেয়েছিলেন। এরই ক্ষমতা বলে আপনারা অসুরদের পরাজিত করেছেন।
আপনাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। পরব্রহ্ম চেয়েছিলেন আপনাদের গর্ব খর্ব করে এই জ্ঞান শিক্ষা দিতে যে আপনাদের শক্তি নয়, তারই শক্তিতে আপনারা জয়লাভ করেছেন।
মানুষ যখনই কোন সাফল্য অর্জন করেছি অথবা উৎকৃষ্টতা লাভ করেছি তখনই তা দৈব বলে অথবা স্রষ্টার কৃপায় হয়েছে এ কথা আমাদের অনুভব করতে হবে। আমাদের যা প্রয়োজন তা হল ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ। ঈশ্বর চান আমরা অজ্ঞতার বন্ধন থেকে মুক্ত হই। যেদিন আমরা অজ্ঞতা হতে মুক্ত হব, সেইদিন তার আনন্দের পরিসীমা থাকবে না।
করোনা আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে মৃত্যু খুব সন্নিকটে। যে কোনো সময় শক্তিশালী মানুষ চলে যেতে পারেন। এই অবস্থায় আমরা যদি ঈশ্বরকে পেতে চাই বা তার ক্ষমা পেতে চাই, তাহলে আমাদের সহজ সরল জীবন যাপন করতে হবে। একটি দিনে মাত্র চব্বিশটি ঘণ্টা সময় আছে এই চব্বিশ ঘণ্টা ফুরোলে তা আর ফিরে আসবে না। আমি যদি এক ঘণ্টা সময়ও নষ্ট করি তাহলে তা আর কোনদিনও ফিরে পাব না। সে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হবে না। আমাকে স্থির করতে হবে ক্ষণিক মুহূর্তগুলো আমি কিভাবে যাপন করব, পার্থিব সুখের জন্যে না ঈশ্বর চিন্তায়? আমরা যদি এই বোধ হয় যে ঈশ্বর লাভই আমার সবচাইতে বড় প্রয়োজন তাই জীবনকে যদি সহজ সরল করে নিই, আমি উদভ্রান্ত অথবা প্রলোভিত হব না।
এই পৃথিবীতে আমরা কত কিছু করছি যা বৃথা ও অপ্রয়োজনীয়। আমাদের অনেক কিছু আছে যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আমাদের একটি গাড়ি থাকলে আর একটিও পেতে ইচ্ছে করে। একটি বাড়ি থাকলে আরও একটি পাবার ইচ্ছে হয়। যৎ সামান্য যা আমাদের বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজন তার ওপর আমাদের অস্তিত্বের নির্ভর না রেখে আমরা কেবলই চেষ্টা করি পার্থিব বস্তু সমূহ বাড়িয়ে তুলতে। কিন্ত আমরা কি চাই তা সঠিকভাবে জানতে হবে। অহেতুক সম্পদের প্রেম ছেড়ে পরম প্রভুর সন্তুষ্টিই আমার বিপদমুক্ত করতে পারে। আসুন সৃষ্টির কল্যাণে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে তার ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী