থেকে যায় শুধু রেখে যাওয়া সময়টুকুই
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩৩ পিএম, ১৫ জুন ২০২০ সোমবার
করোনা সঙ্কটকালে মুখোমুখি সাহচর্য্য আর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। দূরে অবরুদ্ধ হয়ে আছি বহু প্রিয়জন থেকে, দেখি না কত স্বজন-বান্ধবদের কত দিন! কত দিন সময় কাটাইনি পরিচিতজনদের সঙ্গে। অথচ মানুষে মানুষে সময় কাটানো হচ্ছে সাহচর্য্যের, আনন্দের এবং সান্নিধ্যের। চূড়ান্ত বিচারে আমরা সে সাহচর্য্যের, আনন্দের আর সান্নিধ্যের হিরন্ময় স্মৃতিটুকুই হৃদয়ে ধারণ করি - আর সব তুচ্ছ হয়ে যায়।
ভালোবাসার সময়, মমতার সময়, বন্ধুত্বের সময়, গল্পের সময়, কাছে বসে থাকার সময়, আড্ডার সময় এটাই সব মানবিক সম্পর্ক আর মূল ভিত্তি। একজন মানুষ আরেকজনের কাছে সময়টাই শুধু চায় নিজের কথা বলতে, অন্যের গল্প শুনতে, দু:খ আর আনন্দ ভাগ করে নিতে। কিন্ত প্রায়শ:ই এটা আমরা বিস্মৃত হই।
এই দু:খজনক বিস্মৃতির কারনে আমরা প্রয়োজনকে গুরুত্বপূর্ণের চেয়ে বেশী মূল্যবান মনে করি। তাই প্রায়শ:ই আমরা প্রিয়জনদের পার্থিব বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোকেই বেশী মূল্যবান মনে করি, তাদের মনের চাহিদা মেটানোর জন্য যে সময় দেয়া দরকার সেটাকে গৌণ মনে করি।
আবার কখনো কখনো নিজেকে নিয়ে এতো আচ্ছন্ন থাকি যে মনে করি, আমার সময়টা শুধু আমারই জন্য। জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়ে আমরা সময়ের পেছনে ছুটি অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির জন্য, খ্যাতির আশায়, যশের কাঙালপনায়। আমরা ভুলে যাই যে, আমার চেয়েও অর্থবান আরো আছে, আমার চেয়ে আরো খ্যাতিমান অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও আসবে।
অনেকেই মনে করেন যে, একত্রে সময় কাটাতে হলে কোনকিছু একটা কিছু করতেই হবে, কথা বলতেই হবে, কোন অংশ ফাঁকা রাখা যাবে না। আমার বাবার কথা মনে হলো - স্বল্পবাকের মানুষ, যাঁর স্নেহ বোধের, প্রদর্শনীর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন শিক্ষকতা করি তখন ছুটি-ছাটাতে বরিশালে গেলে আমাদের বাংলো-সদৃশ বাড়ীর সামনের দু'দিকে দু'টো লাল রঙ্গের সিমেন্টের বেঞ্চিতে আমরা দু'জনেই প্রায়ই বসতাম বিকেলে। দু'একটা কথা হত - কিন্তু তাতেই আমার মন ভরে যেত। তাঁর কাছাকাছি আছি, সেটাই বড় পাওয়া মনে হত। তিনি চুপ করে থাকলেও জানতাম তিনি আমাদের কথাই ভাবছেন। নিস্তব্ধতা যে কতটা বাঙময় হতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারতাম এবং বুঝতে পারতাম যে নিশ্চুপও কথা বলে।
আজকাল 'গুণগত সময় কাটানো' বলে একটা কথা শুনতে পাই। এ ধারণাটি শুধু পশ্চিমাই নয়, যান্ত্রিকও বটে। আনন্দঘন, সুনন্দ ও সুপ্রিয় সময় কাটানোর সবচেয়ে বড নিক্তি হচ্ছে তার স্বভাবগত স্বাভাবিকতা। সেখানে মমতা থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে, তর্ক থাকবে, কথা থাকবে, চিৎকার থাকবে, কলহও থাকবে। যে মমতায় কলহের অধিকার নেই, সে মমতা মেকী।
জীবন শেষে যা আমরা রেখে যাই, তা অর্থ নয়, কীর্তি নয়, শুধু সতত: সুখের সময়ের হিরন্ময় স্মৃতি।
এনএস/