ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

নোবিপ্রবির অধ্যাপক ড. বেলালের সফলতার গল্প

আব্দুর রহিম, নোবিপ্রবি:

প্রকাশিত : ১০:০২ পিএম, ১৬ জুন ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:০৬ পিএম, ১৬ জুন ২০২০ মঙ্গলবার

স্বপ্ন! সফলতা! শব্দগুলো শুনলে সবারই আলাদা একটি অনুভূতি কাজ করে থাকে। স্বপ্ন এবং সফলতার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা না থাকলেও আমরা বিভিন্নভাবে শব্দগুলোকে সংজ্ঞায়ন করে থাকি। জীবনে সবারই স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারাকেই আমরা সাধারণত সফলতা বলে থাকি। কিন্তু আজকে তুলে ধরব ব্যতিক্রমধর্মী এক সফলতার গল্প-

ছোটবেলায় হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। তবে বড় হয়ে হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। শিক্ষা, গবেষণা,সততা,নিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক জনপ্রিয় এই শিক্ষক। তার আরও একটি পরিচয় হলো–তিনি একজন কৃতী গবেষক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে তার অর্জন হলো–তিনিই বাংলাদেশের প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি প্রাণিজগতের পাঁচটি নতুন অমেরুদন্ডী প্রাণী আবিষ্কার করেছেন। ফলে তার সুনাম ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। 

বলছিলাম নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড.বেলাল হোসেনের কথা। জন্ম তার কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়। বাবা আব্দুস সোবাহান বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের সবার বড় বেলাল। গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। ফলে বলতে ভালোবাসেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে।’ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চলে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সেখানেই তার গবেষণা জীবনের শুরু। এরপর ২০০৩ সালে ডিএফআইডি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে  ইংল্যান্ডের নামকরা হাল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করেন। মাস্টার্স ডিগ্রী শেষে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায়।

২০০৮ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুর করেন তিনি। দুই বছর পর শিক্ষা ছুটিতে চলে যান পিএইচডি করতে। ব্রুনাইয়ের বিখ্যাত দারুস সালাম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি, অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেছেন। ড.বেলাল বলেন, ‘২০০২ সাল থেকে আমার গবেষণা-জীবনের সেই যে শুরু, আজও থামিনি।’ ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ‘ন্যাফটাইস বাংলাদেশি’ নামের প্রথম একটি অমেরুদন্ডী পলিকীটের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেন। ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারীতে 'ন্যাফটাইস বাংলাদেশি’ এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। ব্রুনাইয়ে থাকার সময় সেই দেশের সাগর উপকূল চষে বেড়িয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ‘ভিক্টোরিওপিসা ব্রুনেইয়েনসিস’ নামের আরেকটি অমেরুদন্ডী নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেন। ২০১৬ সালের ১ জুন আবিষ্কৃত নতুন এই এম্পিপোডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন।

২০১৮ সালে এই কৃতি অধ্যাপক নোয়াখালী উপকূলীয় এলাকা থেকে আরও দুটি ‘নিউমেনিয়া নোবিপ্রবিয়া’ ও ‘অ্যারেনুরাস স্মিটি’ নামের নতুন অমেরুদন্ডী প্রাণী  আবিষ্কার করেন। ২০১৮ সালে ১৪ মে মাইটস দুইটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। এই গবেষক অাবিষ্কৃত প্রথমটির নাম দিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) নামে। এভাবেই প্রাণীর জীবনে এক বিজ্ঞানী তার বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর দ্বিতীয় প্রাণীটির নাম দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের বিশ্ববিখ্যাত একারোলজিস্ট হ্যারি স্মিথের নামে। 

২০২০ সালে নোয়াখালীর হাতিয়া উপকূলের জলাভূমি থেকে ‘গ্লাইসেরা শেখমুজিবি’ নামে আরেকটি নতুন অমেরুদণ্ডী পলিকীটের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেন ড.বেলাল। তাঁর এই সাফল্য যাত্রায় গবেষনার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পলিকীট বিজ্ঞানী ড. প্যাট হ্যাচিংস। ২০২০ সালে ২৬ মে 'গ্লাইসেরা শেখমুজিবি ' এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন। তবে অমেরুদণ্ডী প্রাণীটির নামকরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন চলেছিল নানা আলোচনা, সমালোচনা। প্রাণীটির নামকরণ নিয়ে ড. বেলাল বলেন, নতুন আবিষ্কৃত প্রাণীর নাম যেকোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা-বাদশা,বিখ্যাত ব্যক্তি,গায়ক,খেলোয়াড়, কবি,লেখক যেকারো নামে রাখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গৌরবময় ভূমিকা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য অবদান চির স্মরণীয় করে রাখতে এই নামকরণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তার বাল্যকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ দেশের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীনচেতা, মুক্তিপাগল, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ও আপোষহীন বঙ্গবন্ধুকে এ জন্য বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। তার দক্ষতা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে স্বাধীনতাত্তোর ধ্বংসস্তূপের বাংলাদেশকে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি যুগোপযোগী কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তিনি। তার সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান— বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১১টি গবেষণা পরীক্ষাগার আছে।

ড. বেলাল হোসেন বললেন, ‘আমাদের দেশের উপকূল সমুদ্র অঞ্চল দিনের পর দিন গবেষণার জন্য ঘুরে বেড়ানো, কাজের সূত্রে জানি এই দেশের এই অঞ্চল খুবই জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। তবে সেগুলো নিয়ে কোনো গবেষকই  তেমন গবেষণা করেন না। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও উদ্যোগ নেই। ফলে গবেষণার অপ্রতুলতায় বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ভাগসহ অন্যান্য জায়গার জীববৈচিত্র্যের পূর্ণ তালিকা এখনো তৈরি করা যায়নি।’ তবে তিনি দিলেন খুশির খবর–এখন থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজে এগিয়ে আসবে বলে আশাবাদী। আর আমাদের আবিষ্কার দুটির মধ্যে নিউমেনিয়া নোবিপ্রবিয়ার নাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত ‘নোবিপ্রবি’র সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছি।’ 

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা সম্ভব হবে বলে সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক জানিয়েছেন। নতুন পাওয়া এই প্রাণীগুলো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাস্তুসংস্থানে যে খাদ্য শৃঙ্খল আছে, তাতে নানা স্তরের খাদক আছে। প্রতিটি স্তরের খাদক অন্য স্তরের খাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছে। যে প্রাণীগুলো আবিষ্কার করছি এগুলো প্রথম স্তরের খাদক। তাদের খেয়েই খাদ্য শৃঙ্খল শুর“ হয়।’ 

গবেষণা কর্মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেমন সাহায্য করে? ড. বেলাল বলেন, ‘আমার নিজের বিভাগ থেকে কোনো ফান্ড বা অনুদান পাইনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সুবিধা ব্যবহার করেছি। পুরো গবেষণার টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়েছি। এর আগে যে দুটি আবিষ্কার করেছি, সেগুলোও বিদেশের গবেষণা ফান্ড–অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের। তবে এ ধরনের গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান দেওয়ার নিয়ম নেই। যারা এ ধরনের গবেষণা করেন, সাধারণত নিজস্ব ফান্ডেই করেন।’ নিজেকে আপাদমস্তক শিক্ষক বলতে ভালোবাসেন তিনি। এই পেশা বেছে নেওয়ার কারণ কি? ‘ছোটবেলা থেকে আমার শিক্ষকতার প্রতি দুর্বলতা, টান আছে। ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়েছিলাম, যদিও সেখানে থাকা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। চাইলে ইংল্যান্ড,আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিতে পারতাম। কিন্তু প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি বলে এইদেশে চলে এসেছি। কারণ বাংলাদেশে থেকে আমি নিজে শিখব ও ছাত্রছাত্রীদের শেখাব। 

আরকে//