দ্বিতীয় দফা আলোচনাও ব্যর্থ, লাদাখে শক্তি বাড়াচ্ছে চীন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৪৩ এএম, ১৯ জুন ২০২০ শুক্রবার
লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সংঘর্ষে দুই দেশের অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিহতের পর কিছুটা কমেছে উত্তেজনার পারদ। কিন্তু, কাঙ্খিত সমাধানে দ্বিতীয় দফা আলোচনায়ও কাজে আসলো না। ফলে গতকালের পর আজ বৃহস্পতিবারেও দুই দেশের মেজর জেনারেল পর্যায়ের বৈঠকে অধরাই রইল সমাধান সূত্র।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) প্রায় ৬ ঘণ্টা বৈঠক করেন দু’দেশের সেনাকর্তারা। কিন্তু তারপরেও পূর্ব লাদাখে ভারতের জমি ছেড়ে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখায়নি চীনা সেনারা। উল্টো দখল করা ভূখণ্ডে আজ নিজেদের শক্তি আরও বাড়িয়েছে চীনের পিপল্স লিবারেশন আর্মি।
এই অবস্থায় পাল্টা পেশি শক্তি দেখাতে আজ ১২টি সুখোই ও ২১টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব জমা দিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। যা কিনতে খরচ হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গত দু’দশক ধরেই ভারতীয় বায়ুসেনার অন্যতম ভরসা হল সুখোই। কয়েক স্কোয়াড্রন সুখোই এখন সীমান্ত সংলগ্ন ফরওয়ার্ড বেসগুলিতে এনে রাখা হয়েছে। আগামী মাস থেকে অত্যাধুনিক রাফাল বিমানও আসতে শুরু করবে বলে জানিয়েছে বায়ুসেনা।
কিন্তু দেশিয় রাজনীতির স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পেশি প্রদর্শনের পথ নিলেও পূর্ব লাদাখে ভারতের পক্ষে এই মুহূর্তে রণকৌশলগতভাবে কোনও বড় পদক্ষেপ করা কঠিন বলেই মত সামরিক বিশেষজ্ঞদের। কারণ, যেভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডের কয়েক কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে চীনা সেনা ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে, তাতে তাদের হটাতে গেলে ইনফ্যান্ট্রি বা স্পেশাল ফোর্স-কে নামাতে হবে।
কিন্তু গালওয়ান উপত্যকায় সোমবার রাতের সংঘর্ষের পরে সেখানে সামরিক শক্তি আরও বাড়াচ্ছে চীন। ভারতের অভিযোগ, নিজেদের স্বার্থে গালওয়ান নদীর ধারাও পাল্টে দিতে শুরু করেছে তারা। এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিকল্প হল বিমান হামলা। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় বিমান হামলার সীমাবদ্ধতা কার্গিল যুদ্ধের সময়েই স্পষ্ট হয়েছিল। ওই ধরনের হামলায় নিজেদের সেনার হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর স্পেশাল ফোর্স নামানো বা বিমান হামলার অর্থই হল পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া। যা আদৌও কাম্য নয় দিল্লির।
ফলে ভারতের হাতে আলোচনা ছাড়া সেই অর্থে অন্য কোনও রাস্তা আপাতত খোলা নেই। যদিও গত দু’দিনের আলোচনায় অগ্রগতি হয়নি এক চুলও।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ন আজ বলেছেন, ‘গালওয়ান উপত্যকায় যে গভীর উদ্বেগজনক সংঘাত ঘটেছে, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে দু’দেশই সহমত। শান্তি সুরক্ষিত রাখা ও উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে আলোচনা চলছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণে।’
কিন্তু চীন যেভাবে গালওয়ান উপত্যকাকে নিজেদের বলে দাবি তুলে সুর চড়াচ্ছে, তাতে তারা যে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে, সেটা প্রমাণ করাই ভারতের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন তার প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশ-যেমন, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার-সকলের সঙ্গেই সীমান্ত সমস্যা জিইয়ে রাখে। যা তাদের সীমান্ত বিস্তারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির অংশ। ফলে লাদাখের মাটিতে পরিকাঠামো গড়ে জাঁকিয়ে বসা চীনা সেনার আশু ফিরে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। চীনের এই মনোভাবের নিরিখে আলোচনায় কতটা কাজ হবে, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
সোমবার রাতের ঘটনার পরেই হতাহতের পাশাপশি কতজন ভারতীয় সেনা নিখোঁজ, তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। সেনাবাহিনী সূত্রে আজ দাবি করা হয়, কোনও সেনাই নিখোঁজ নন। কিন্তু এত দেরি করে কেন মুখ খোলা হল, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
সেনা সূত্রে আজ আরও বলা হয়েছে, ৭৬ জন জওয়ান এখনও হাসপাতালে ভর্তি। তবে তাদের সকলের অবস্থাই স্থিতিশীল। অন্তত ৫৮ জন এক সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সোমবার রাতের সংঘর্ষে গুলি না-চললেও, চীনা সেনারা পেরেক লাগানো লাঠি দিয়ে হামলা চালায় বলে জানিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নিহত ভারতীয় সেনাদের দেহে তীক্ষ্ণ গভীর ক্ষত লক্ষ্য করা গেছে। পরে পেরেক লাগানো লাঠি উদ্ধারও করে ভারতীয় সেনারা।
এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর প্রশ্ন, ‘কেন অস্ত্রহীন অবস্থায় জওয়ানদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল?’ জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘গালওয়ানে যে দলটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। সীমান্তরক্ষার দায়িত্বে থাকা সব জওয়ানের কাছেই তা থাকে। কিন্তু প্রোটোকল মেনেই তারা তা ব্যবহার করেননি।’
এহেন প্রোটোকল নিয়ে প্রশ্ন তুলে পাঞ্জাবের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহের মন্তব্য, ‘যখন সঙ্গীরা খুন হচ্ছেন, তখন কেন জওয়ানেরা অস্ত্র ব্যবহার করে পাল্টা জবাব দিলেন না, তা দেশ জানতে চায়।’
সেনা সূত্রে বলা হয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পাহারার প্রশ্নে ১৯৯৬ ও ২০০৫ সালের প্রোটোকল এবং ‘রুল অব এনগেজমেন্ট’ অনুযায়ী পাহারার সময়ে হাতে অস্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার না-করাই নিয়ম।
তবে প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এস পানাঘের মতে, ‘যদি প্রাণের আশঙ্কা, ভূখণ্ড বা সিকিউরিটি পোস্ট আক্রান্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তা হলে কমান্ডার স্তরের অফিসার তার বাহিনীর হাতে থাকা সমস্ত ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিতে পারেন।’
এআই//