হাঁকের ডাক ও ডাকের হাঁক
সেলিম জাহান
প্রকাশিত : ০২:৫৪ পিএম, ১৯ জুন ২০২০ শুক্রবার
আইসক্রীমের গাড়ির শব্দটি রাস্তার মোড়টায় মিলিয়ে গেলো। আমাদের বাড়ির সামনের দিকে ঘণ্টি বাজিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলো গাড়িটি। চালক বোধহয় আশা করেছিলেন যে, কোন না কোন বাড়ি থেকে শিশুদের ডাক আসবে। কিন্তু আসেনি এই করোনার কালে। তবে ওই ঘণ্টির ধ্বণি তো আমার চিরচেনা। প্রথম শুনেছিলাম মন্ট্রিয়ালে বছর তেতাল্লিশ আগে, তারপর শুনেছি নিউ ইয়র্ক, লণ্ডনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে।
আহা, সেই পরিচিত আইসক্রীম গাড়ির ঘণ্টির শব্দ তো এখনও টিকে আছে, কিন্তু কিছু কিছু হাঁক-ডাক যার সঙ্গে একসময় নিত্যদিনের পরিচয় ছিল, তা আর শুনিনা বহুকাল। কোন কোন হাঁকের কারণ লুপ্ত হয়েছে, কোন কোন ডাকের আর প্রয়োজন নেই।
চৈত্র মাসের তপ্ত দুপুর যখন হাওয়ার বিকেলে রূপান্তরিত হতো তখন বেরুত তারা। মাথায় লাল শালু ঢাকা বড় মাটির ভাঁড়। সুরেলা গলায় হাঁক দিত তারা - 'কুলপি মালাইই বররপ'। মাটির ভাঁড়ের ভেতর থেকে বেরুত ময়দা দিয়ে আটকানো লোহার ত্রিভুজাকৃতির ছোট ছোট শঙ্কু। একটি ছুরি দিয়ে ছাড়িয়ে কাঁচের প্লেটে উপুড় করে দিয়ে দেয়া হতো মিষ্টি কুলপি, যার থেকে ভুর ভুর করে বেরুতো এলাচের গন্ধ। বরিশালের সুরকি ঢাকা পথে ভবেশ কুলপিওয়ালার হাঁক শুনলেই ছুটতাম সদর দরজার দিকে।
শীতের সকালে যখন টিনের চালে টুপ টুপ করে শিশির পড়ত, যখন লেপের ওম ছাড়তে প্রবল আলসেমি, তখন গলির মোড়ে শোনা যেত যতীন বেয়ারার ডাক - 'মাক্ষম'। বহু বলে কয়ে ও তাকে দিয়ে 'মাখন' বলানো যেত না। কলা পাতায় মোড়ায় সে মাখনের গায়ে লেগে থাকত বিন্দু বিন্দু জল। গরম গরম রুটি টেবিলে এলে ঘখন সেই কলা পাতার মোড়ক খোলা হতো, কখনো ঈষৎ হলদেটে সে মাখনের সুবাস ছড়িয়ে পড়ত চতুর্দিকে। রুটিতে সে মাখন লাগিয়ে একটু চিনি ছড়িয়ে দিলে সে কি স্বাদ। আমাদের বাড়িতে শীতলীরক্ষণ যন্ত্র আসেনি তখনো। তাই মাখন সংরক্ষণের জন্যে মা একটি বাটিতে জল দিয়ে অব্যবহৃত মাখনের টুকরোটি ছেড়ে দিতেন আগামী দিনের ব্যবহারের জন্যে।
ছুটির দিনে দুপুর এগারোটার দিকে হাঁক ভেসে আসতো ‘আছে নি, শিশি-বোতল, বই-খাতা, পুরান কাগুজ?’ এ ডাক শুনলে মা’কে আর রোখা যেত না। সব কাজ ফেলে তিনি উঠে আসতেন এবং আমাদের কাজ বেড়ে যেত। বার করতে হতো গুদামঘর থেকে টাল করা পুরোনো খবরের কাগজ, ওপরের তাক থেকে নামিয়ে আনতে হতো খালি শিশি, বোতল এবং সেই সঙ্গে খালি টিন। আমাদের পুরোনো কোন খাতা আছে কিনা, তা নিয়ে একশো বার জেরা করা হতো। সেগুলো পেলে ফেরিওয়ালা খাতার মলাট ছিঁড়ে শুধু ভেতরের পাতাগুলো নিতে চাইতেন। সেখানেই ছিলো মায়ের আপত্তি। তাঁর মতে, এটা করেই ফেরিওয়ালা ওজনে ঠকাতে চাইছে। তবে সবচেয়ে বড় চাহিদা ছিল পুরোনো কাপড়ের এবং মা বাবার পুরোনো প্যান্ট, শার্ট, ও অন্যান্য কাপড়-চোপড় বার করে নিয়ে। দু’দিন পরেই বড় রকমের ঝামেলা হতো, যখন বাবা ঐ সব কাপড়-চোপড়ের খোঁজা-খুঁজি করতেন।
দুপুর বেলা পাড়ায় পাড়ায় ডাক শোনা যেত 'দশ হাতকার এক আনা'। কালো মোটা সুতোর দশহাত এক আনায় বিক্রি হতো -ঐ সুতো দিয়ে বাচ্চাদের কোমরে ঘুঙুর বেঁধে দেয়া হতো, যা তাদের গতিবিধির জানান দিত। মনে আছে ‘শহরেরে ইতিকথা’ ছবিতে উত্তম কুমারের সেই ‘নীলামওয়ালা ছ’আনা, লে লে বাবু ছ’আনা’ গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। এমন হাঁক শোনা যেত আমাদের অলিতে-গলিতে আমাদের শৈশবে। দুপুরে বাড়ির কর্তারা যখন কাজে এবং গিন্নীরা যখন সব কাজ শেষে বিশ্রাম করছেন, তখন বেরুতেন ‘ছিট কাপুড়’ ওয়ালারা। তাঁরা সামনে সামনে হাঁটতেন আর পেছনে কোরা মার্কিন গাঁটরি কাঁধে তাঁদের সহকারীরা। বাড়ির বারান্দায় গাঁটরি নামানো হতো। বাড়ির মেয়েরা এসে জড়ো হতেন। গাঁটরি খুলে বেরুতো নানান রকমের ছিট কাপড়। তারপর যে দর কষাকষি শুরু হতো, তার কাছে কোথায় লাগে ‘আরব-ইসরায়েল আলোচনা’।
মাঝে মাঝে হাঁক শোনা যেত, ‘চাই কাচের চুড়ি, ফিতা’। কাঠের তৈরী ওপরের কাঁচ দেয়া বাক্সে থরে থরে সাজানো থাকত নানান মাপের, নানান রঙের কাচের চুড়ি। কোনার দিকে গোল করা নানান রঙের ফিতে।
শীতের দিনে শুনতাম, ‘করাবেন নি লেপ-তোষক’? তারপরেই ধুন যন্ত্রের টঙ্কার। সামনে ধূনকর, পেছনে তুলার গাঁটরি কাঁধে তাঁর সহকারী। অথবা ‘ধার করাবেন নি বঁটি, দা’? আমার খুব ভালো লাগতো ‘খোঁটাবেন নি পাডা-পুতা’? একজনকে বলতে শুনেছি কবিতার মতো করে, ‘পাডা কি খোঁডাইবেন, পয়সা কি দেবেন?’ তবে তাঁদের হাঁকের চাইতে ভালো লাগতো ছোট্ট একটা হাতুড়ি আর বাটালি দিয়ে নক্সা করে পাটা খোঁটানো। বিকেলের দিকে লাল পায়জামা-কুর্তা পরা, মাথায় টুপি, পায়ে ঘুঙুর পরে আসতেন চানাচুরওয়ালা। হাঁক দিতেন, ‘ঘটি গরম’। শোনা যেত ডাক ‘হট প্যাটিস’।
এখনও চোখ বুঁজলে শুনতে পাই ‘সাপের খেলা’ কিংবা ‘ঘি রাখবেন নি ঘি’? শেষের কথাটি এতো সুন্দর করে ব্যবহার করা হয়েছে ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেনে’, যখন সুজাতা গাইছেন, ‘গান নয়, গান নয়, যেন সাইরেন’। আমাদের বাড়িতে জল সরবরাহ করতেন ‘ভারী’ অক্ষয় দা। অমন পেটানো স্বাস্হ্যের পুরুষ বড় একটা চোখে পড়েনি। উচ্চ স্বরে জানান দিতেন, ‘জল লাব্বে গ’? তাঁর ডাক শুনে মনে পড়ে যেত ‘সপ্তপদী’র রীনা ব্রাউনের কুন্তী মা’র সেই মায়াময় কথা, ‘জল আইচে গ’।
হাঁকের ডাকের আর ডাকের হাঁকের কত হাঁক-ডাক যে হারিয়ে গেছে। কানের শ্রবনে এই সব হাঁক-ডাক আর শুনি না, কিন্তু স্মৃতির শ্রবনে তাদের নিত্য আসা-যাওয়া।
এনএস/