ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

নৌকাডুবিতে দম্পতির মৃত্যু

ফিডার ফিডিংয়েও কান্না থামছে না শিশু তানহার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৩৪ পিএম, ১৯ জুন ২০২০ শুক্রবার

আট মাসের তানহা কোলে নিয়ে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর আহাজারী।-ছবি একুশে টেলিভিশন।

আট মাসের তানহা কোলে নিয়ে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর আহাজারী।-ছবি একুশে টেলিভিশন।

শিশু তানহাকে নতুন জামা-মোজা পরানো হলো না আসলাম-জান্নাত দম্পত্তির। আজ শুক্রবার বিকালে ঘটনাস্থলে লাশ ভেসে ওঠে আসলামের। জান্নাতের লাশের সন্ধান পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আলগী-তেঁতুলিয়া নদীর মিলনস্থল তালতলী পয়েন্ট এলাকায়। ফিডার ফিডিংয়েও এখন উদর-পূর্তির স্বাচ্ছন্দ নেই বাড়িতে স্বজনদের কাছে রেখে যাওয়া তাদের অবুঝ সন্তান তানহার। 

আট মাস বয়সী শিশুর ভাব প্রকাশের সক্ষমতা না থাকলেও দৃষ্টিতে যেন বাবা-মা হারানোর এক অবর্ণণীয় অসহায়ত্ব। আর স্বজনদের আহাজারিতে কেবলই মুখে লেগে আছে তার অহরহ কান্নার শব্দ। বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) সকালে মেয়ে তানহাকে নতুন জামা-মোজা পরানোর স্বপ্ন ভেসে যায় পটুয়াখালীর বাউফলের আলগী নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ দম্পত্তি আসলাম-জান্নাতের।

স্বজন ও স্থানীয়রা জানায়, আসলাম-জান্নাত দম্পত্তি কেশবপুর ইউপির ভরিপাশা গ্রামের বাড়ি থেকে লকডাউনে ফেলে আসা বকেয়া বেতন তুলতে চার দিন আগে রওনা হয়ে যান নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিকগঞ্জ ইপিজেড এলাকায়, জান্নাতের কর্মস্থল একটি গার্মেন্টের উদ্দেশে। কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে সেখানে ছুটে গিয়েও বেতন তুলতে ব্যর্থ হয়ে দেরি না করে পুনরায় উঠে বসেন এমভি ঈগল-৪ লঞ্চের ডেকে বাড়ি ফেরার উদ্দেশে, দাদি আলোমতির (আসলামের মা) কাছে রেখে যাওয়া তাদের একমাত্র শিশু সন্তান তানহার টানে। সঙ্গে হাতে পাওয়া একই এলাকায় আসলামের দিন মজুরীর কিছু বকেয়া আর লঞ্চের ভাড়া বাদে দু’জনার হাতে থাকা অবশিষ্ট সামন্য টাকায় কিনে নেন তারা আট মাস বয়সী প্রিয় শিশু সন্তান তানহার জন্য নতুন জামা আর মোজা। 

কিন্তু নিজ স্টেশন নুরাইনপুর ঘাটে নেমে আরো ১০-১২ জনের সঙ্গে খেয়ার নৌকায় উঠে আলগী নদী পার হতে গিয়ে ফিরে আসা ওই লঞ্চের ধাক্কাতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় শিশু তানহাকে নতুন জামা-মোজা পরানোর স্বপ্ন। খেয়ার নৌকা উল্টে নিখোঁজ হন আসলাম-জান্নাত দম্পত্তি। তাদের শিশু সন্তান তানহার জন্য কেনা নতুন জামা-মোজা ভর্তি ট্রাভেল ব্যাগটি পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করা গেলেও উদ্ধার করা যায়নি আসলাম-জান্নাত দম্পতিকে। এ সময় আনোয়ার নামে অপর একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। লঞ্চের ইঞ্জিনের প্রপেলারের দাপটে পানিতে নিখোঁজ হন আসলাম ও জান্নাত। 

আজ শুক্রবার বিকালে ঘটনাস্থলে ঘাটের পন্টুনের সঙ্গে আসলামের ভাসমান লাশ পাওয়া যায়। জান্নাতের লাশ মেলে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আলগী-তেঁতুলিয়া নদীর মিলন পয়েন্টের কাছে তালতলী এলাকায়।

এ ঘটনায় লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ হওয়ায় দম্পত্তি আসলাম-জান্নাতের আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকায় নামে শোকের ছায়া। নাতিনী তানহাকে কোলে নিয়ে আসলামের মা আলোমতি বিলাপ করছেন। পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার হওয়া ট্রাভেল ব্যাগে পাওয়া নাতি তানহার জন্য তার ছেলে ও ছেলের বৌয়ের কেনা নতুন জামা-মোজা দেখাচ্ছেন আর বলছেন, ‘তোমরা আমার পোলা-বৌডারে আইন্যা দেও।’ আসলামের বাবা আলম শরিফ বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে কেবল তাকাচ্ছেন এদিক-সেদিক। শান্তনার চেষ্টায় তাদেরকে ঘিরে আশপাশের লোকজন। 

লঞ্চ স্টাফদের অসতর্কতার কারণে নৌকা ডুবির ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবী করেছেন আজ শুক্রবার দুপুরেও ঘটনাস্থলে নদীর পাড়ে কান্নায় ভেঙে পড়া জান্নাতের বাবা পৌর সদর এলাকার জালাল মোল্লা ও মা সাজেদা বেগমও। 

কান্না জড়িত কণ্ঠে সাজেদা বেগম জানান, বছর চারেক আগে বিয়ে হয় আসলাম ও জান্নাতের। টানাটানির সংসার গ্রামে থেকে কোনমতে চলছিল না। তাই মেয়ের জামাই আসলাম নারায়ণগঞ্জে দিনমজুরী আর একই এলাকায় মেয়ে জান্নাত গার্মেন্টে কাজ করছিলেন। নাতি তানহা আসার পরে ভাড়ার বাসায় থেকে তাকে দেখভালের কাজ করলেও এখন এ অবস্থায় নাতিটাকে রাখা যাচ্ছে না। গার্মেন্টে কাজের সময় বিরতিতে বাসায় এসে মেয়ে তানহাকে দুধ খাইয়ে যেত জান্নাত। করোনার লকডাউনে বাড়ি এসে গার্মেন্ট মালিক পক্ষের কথা মতো তানহাকে তার দাদির কাছে রেখেইে বেতন তুলতে যায় ওরা দু’জন। এখন ফিডার ফিডিংয়েও স্বাচ্ছন্দ নেই। রাখা যাচ্ছে না কোন মতে। কোন কিছু না বুঝলেও কান্না করছে অহরহ। কিছু না বুঝলেও মায়ের অনুপস্থিতিতে অস্থির হয়ে উঠছে শিশু তানহা। দূর্ঘটনার সঠিক তদন্ত করে বিচারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা ডুবিতে আসলাম-জান্নাত দম্পতিসহ তিন জন নিহতের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্থানয়ীরাও। সেলিম, জালাল চৌকিদার, শাহআলম হাওলাদার, আবুল কালাম, আলমগীর হোসেন, নান্নু নামে কয়েকজন বলেন, ‘লঞ্চের ড্রাইভার (মাষ্টার) হানিফ মিয়াসহ লঞ্চ স্টাফদের অসতর্কতার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।’

এ ঘটনায় প্রশাসনের লোকজনের উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা ছিল না উল্লেখ করে তারা জানান, এতবড় একটা দুর্ঘটনার পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা থানার ওসি একবারের জন্যও বাড়িতে এসে এই ছোট্ট দুধের শিশুটির খোঁজ নেননি। ঘটনাস্থলেও আসেননি কোন ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি। উপরন্তু স্থানীয় লোকজন লঞ্চটিকে আটক করলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে তা আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। লাশ উদ্ধারের ব্যাপারেও প্রশাসনের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না।’

অভিযোগ অস্বীকার করে এমভি ঈগল-৪ লঞ্চটির ড্রাইভার হানিফ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘নদীর স্রোতে নৌকা এসে লঞ্চের সঙ্গে থাক্কা খায়।’ তার দাবি লঞ্চ ঘাটে নোঙর করা ছিল। এখানে তার অসাবধানতার কিছু ছিল না। লঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঘটনায় লঞ্চ স্টাফদের কোন ভুল নেই। নৌকা লঞ্চে ধাক্কা লাগে নি।’

বাউফল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লাশ উদ্ধারে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। আগের দিন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়।’

এনএস/