কামাল লোহানীর প্রয়াণ ও আমাদের শীতনিন্দ্রা!
মানিক মুনতাসির
প্রকাশিত : ০৭:৩০ পিএম, ২০ জুন ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৮:৩৩ পিএম, ২০ জুন ২০২০ শনিবার
আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।
বিজ্ঞানের একটি বিতর্কিত ইস্যু হলো- কোন কোন প্রাণীর শীতনিদ্রা। এর পক্ষে অকাট্য কোন দলিল না থাকলেও বিষয়টা বেশ আলোচিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যও। বিজ্ঞানীদের ধারণা- ভল্লুক, শামুক, সাপ, কাঠবিড়ালী মৌমাছি, কুকুরসহ বেশ কিছু প্রাণী শীতকালে অবিরত নিদ্রাযাপান করে। সেটা ছয় মাস পর্যন্তও হতে পারে। এ সময় তারা বাইরে থেকে কোন খাবারও নেয় না। এই নিদ্রায় যাওয়ার আগে এসব পাণী প্রচুর পরিমাণ স্নেহ ও তেল জাতীয় খাবার গ্রহণ করে। যা তারা শরীরে ধারণ করে পরবর্তীতে শীতনিদ্রাকালে সেটার মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। এ সময় তারা পৃথিবীর কোন কিছুর সঙ্গে যুক্তও থাকে না।
ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শীত নিদ্রায় যায়। সেটা স্ব স্ব এলাকার আবহাওয়া ও প্রতিবেশের ওপর নির্ভর করে। আর শীতনিন্দ্রার স্থান হিসেবে নির্জন জঙ্গলে বা পাহাড়ের কোন গুহা, গাছের কোন কোটর, মাটির নিচের কোন সুড়ঙ্গকেই তারা বেছে নেয়। যেখানে কোন ধরনের অসুবিধা বোধ হবে না।
বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্বের সঙ্গে একজন ১৮শ শতকের কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্যের “কাজের লোক” কবিতার বেশ মিল পাওয়া যায়। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে কবিতার কিছু পংক্তি এ রকম পিপীলিকা, পিপীলিকা, দলবল ছাড়ি একা কোথা যাও, যাও ভাই বলি৷ শীতের সঞ্চয় চাই, খাদ্য খুজিতেছি তাই, ছয় পায়ে পিলপিল চলি!
এবার আসুন, মূল আলোচনায় প্রবেশ করি। প্রখ্যাত সাংবাদিক, ভাষা সৈনিক, মহান মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী আজ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। খবরটা খুবই বেদনাবিধুর। তাঁর আসল নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। কিন্তু তিনি কামাল লোহানী নামেই পরিচিত। ক্ষণজন্মা এই পুরুষকে হারানোর আগে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামনকে। এছাড়া আরো অনেক সাংবাদিক, চিকিৎসক, পুলিশ, রজানীতিবিদসহ এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ মারা গেছেন।
আজ থেকে তিন মাস আগে ৮ মার্চ যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় বাংলাদেশে। শুরুতে আমরা এটাকে পাত্তাই দেইনি। ব্যস্ত থেকেছি নানা কাজে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা জোরালো কোনও প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারিনি। বরং ফিরে আসা প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর নামে যে অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছি, তা নিশ্চইয়ই বিশ্বের ইতহাসে বিরল। এরপর বিমান বন্দর বন্ধ করা, গার্মেন্টস বন্ধ করা আবার খোলা, শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া, তাদেরকে গ্রামে পাঠানো আবার ডেকে নিয়ে আসা -এসব নিয়ে আমরা যা করেছি, সেটাও হয়তো আর কোন দেশে হয়েছে কিনা- সন্দেহ রয়েছে যথেষ্ট।
এ সময় আমাদের প্রশাসন, নীতি নির্ধারকগণ, সরকার- কোন একটি অর্গানও সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পেরেছে বলে প্রমাণ নেই। বরং কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিস্তব্ধতা, নীরবতায় মনে হয়েছে তারা শীতনিদ্রা পালন করছেন। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আমরা আক্রান্তের হারে ১৭তম স্থানে চলে এসেছি। এরপর এখনো লাল, হলুদ আর সবুজ জোনের সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছি। মনে হচ্ছে- আমাদের কোন কোন সংস্থা এখনো সেই শীতনিদ্রায় রয়েছে। যদিও বর্ষাকাল চলছে এখন।
লেখক
এক সময় এটা ভিন দেশে ছিল। পরে আসলো পাশের দেশে। এরপর নিজ দেশে। আগে মারা যেত ভিন দেশে। তারপর নিজ দেশে। এখন মারা যাচ্ছে নিজ পরিবারের লোকজন। নিজেই কোনদিন এই করোনার শিকার হয়ে মারা যাবো, সেটাও হয়তো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে আশার দিক হলো- এটাতে মৃত্যু হার কমে এসেছে। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাটাও বাড়ছে। একই সঙ্গে জটিল উপসর্গের রোগীও কম। কিন্তু সমস্যা হলো- আমরা হয়তো এখানো এটাকে সিরিয়াস কোন রোগ হিসেবে ভাবছি না। হয়তো সেটাই। হ্যাঁ এটা সিরিয়াস নয়। কিন্তু প্রাণঘাতী। একই সঙ্গে এটার কারণে আক্রান্ত কিংবা আক্রান্তের বাইরের মানুষদেরকে যে মানসিক ট্রোমার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটার ভয়াবহতা সত্যিই মারাত্মক। এটার ফল যে কতদিন টানতে হবে তা হয়তো এখনই অনুমেয় নয়।
কামাল লোহানীর মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিকে আমরা হারালাম। হ্যাঁ, তাঁর বয়স হয়েছিল। এটা সত্য। কিন্তু তিনি তো সুস্থ ছিলেন। জীবন মৃত্যু তো পূর্ব নির্ধারিত। যদি করোনা ভাইরাস তাঁকে স্পর্শ না করতো হয়তো তিনি আরো কিছুদিন বাঁচতেন। হয়তোবা নয়। কিন্তু ইতিহাসে লেখা থাকবে তিনি করোনা ভাইরাসে মারা গেছেন। যা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। ইতিমধ্যেই উইকিপিডিয়াতে সেটা লিপিবদ্ধও হয়েছে।
তাঁর সাথে আমার সবশেষ দেখা হয়েছিল গত বছরের অক্টোবর মাসে। একটি লেখা আনতে গিয়েছিলাম। তাঁর সেদিনের কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, এখন তো পত্রিকার দিন শেষ হয়ে আসছে। আবার নতুন করে সম্ভাবনাও জাগছে। এই যে আপনার মতো তরুণরাই হাল ধরার চেষ্টা করছে। তরুণরাই একমাত্র সবকিছু বদলাতে পারে। আপনার তো বয়স অনেক কম। আরো অনেক দিন জাতির সাথে থাকতে পারবেন। বাঁচারও সুযোগ আছে। তাই এমন কিছু করার চেষ্টা করেন। য্টো হবে সত্যিই ব্যতিক্রম। যার জন্য জাতি আপনাকে মনে রাখবে।
সত্যিই তো! আমি করোনায় মারা গেলে জাতি হয়তো মনে রাখবে না। কিন্তু আপনাকে (কামাল লোহানী) অবশ্যই মনে রাখবে এই জাতি। আপনি তো অমর হয়ে থাকবেন। আপনার অবদান তো এ বাঙ্গালী জাতির জন্য গর্বের অবদান। ওপারে ভাল থাকুন। আবার জন্ম হোক, আরো নতুন কোন কামাল লোহানীর। নয়তো আপনারই পুনর্জন্ম হোক। যেটা হয়ে থাকে বিভিন্ন নাটক সিনেমায়। তবে এই মহামারী ভাইরাস নিয়ে নয় কোন নাটকীয়তা। নয় কোন খামখেয়ালি।
এখন হয়তো ভাইরাসকে ঠেকানোর আর কোন রাস্তা নেই। তবে নিজেকে বাঁচানোর রাস্তা হয়তো খোলা রয়েছে। সেজন্য প্রয়োজন সতর্কতা। বাড়তি সচেতনতা আর নিজস্ব চেষ্টা। এটাই এখন একমাত্র অবলম্বন, মুক্তির উপায়।
লেখক- সাংবাদিক।
এনএস/