চীনের ওপর ক্ষুদ্ধ ভারত, চায় প্রতিশোধ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩১ পিএম, ২০ জুন ২০২০ শনিবার
গত ৪৫ বছরে প্রথম বারের মতো চলতি মাসে সীমান্তে ভারত ও চীনের সামরিক সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে ঠিক ঐ একই জায়গায় যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। গত সোমবার ভারতের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা ও চীনের আকসাই চীন সীমান্তে ঐ সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা মারা যান।
ভারতের দাবি, চীন সীমান্তের নিয়ম ভেঙ্গে ভারতের সেনাদের আঘাত করেছে। অন্যদিকে চীন এ দাবি প্রত্যাখান করে ভারতকে দায়ী করেছে। তবে চীনের জন সাধারণ থেকে শুরু করে নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যন্ত সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন চীনের উপর। এক কথা সবাই এখন সরকারকে বলছে এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে।
দুই দেশের মধ্যকার ডি-ফ্যাক্টো সীমান্ত কিংবা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) স্থানে ঐ সংঘর্ষ ঘটে। সেখানে দুই দেশের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
চীনের উপর ভারতের প্রতিশোধ শুধু মাত্র সামরিকভাবেই নয়। বাণিজ্যিকভাবেও প্রতিশোধ নিতে বলা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবেও সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছে ভারত। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশটির বড় বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে ‘সর্বদল’র বৈঠক করেন। এতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই এক মত হয়েছেন নেতারা। তারা ঐক্যের জন্য এক মত হয়েছেন। চীনকে যোগ্য জবাব দেওয়ার প্রশ্নে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন যোগানোর বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একনায়কতান্ত্রিক চীনের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে আমাদের সবাইকে এক হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। একই সঙ্গে বাম দলগুলো আমেরিকার সঙ্গে জোট না করতে মোদীকে পরামর্শ দিয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের উপরে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিকভাবে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সামরিক পদক্ষেপই বা কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্যই এই সর্বদল বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্যিক হোক বা সামরিক, সরকারের যে কোনও পদক্ষেপকে সমর্থনের কথা বলেছে অধিকাংশ দলই। ভারতের রেল, টেলিকম এবং অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে চীনকে কোনভাবে ঢুকতে না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাতে প্রাথমিকভাবে ভারতের কিছু সমস্যা হতে পারে, কিন্তু সেই সমস্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, চীনকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না এমনই কঠোর অবস্থানের পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
লাদাখের সীমান্তে চীনা ও ভারতীয় সেনাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সংশ্লিষ্ট সীমান্ত এলাকায় সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে চীন ও ভারত। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস স্যাটেলাইট ছবির বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা যায়। এদিকে চীনা সৈন্যদের সাথে সংঘাতের জেরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ জন সদস্য মারা যাওয়ার পর প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেও নিজেদের সীমান্ত রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছে ভারত।
বিতর্কিত মানচিত্র ঘিরে ভারতের সঙ্গে নেপালেরও টানাপড়েন চলছেই। তার মধ্যেই লাদাখে ভারত-চীন সংঘর্ষ নিয়ে মুখ খুলল নেপাল। তাদের বক্তব্য, প্রতিবেশী দেশ হওয়ার স্বার্থে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক এবং বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে শান্তিপূর্ণ ভাবে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া উচিত দুই প্রতিবেশী দেশের। সীমান্ত সংঘর্ষের জেরে গত কয়েক দিন ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে নেপাল সরকারের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়, আঞ্চলিক এবং বিশ্ব শান্তির পক্ষে বরাবর তাগিদ এসেছে নেপালের পক্ষ থেকে। তাই শান্তিপূর্ণ ভাবে দুই দেশ বিবাদ মিটিয়ে নিক, এমনটাই চাই আমরা।
এ দিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল রাকেশ কুমার সিং ভাদোরিয়া বলেছেন, ‘আমরা যেকোনও মূল্যে আমাদের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করব। আমরা যেকোনও পরিস্থিতির জবাব দিতে প্রস্তুত। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী সবসময় প্রস্তুত এবং সতর্ক রয়েছে।’ শনিবার গণমাধ্যমে বিমানবাহিনীর প্রধানের ওই মন্তব্য প্রকাশ্যে এসেছে।
গতকাল শুক্রবার টেলিভিশনে প্রচার হওয়া এক বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন ভারতের সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সব ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য পূর্ণ ইঙ্গিত' দেয়া হয়েছে, যেন তারা ভারতের সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। তিনি বলেন, ‘পুরো দেশ চীনের পদক্ষেপের ফলে আহত ও ক্ষুদ্ধ হয়েছে। ভারত শান্তি ও বন্ধুত্ব চায়, কিন্তু সার্বভৌমত্ব ধরে রাখা সর্বাগ্রে।’ মোদী দাবি করেন যে, সোমবারের সংঘর্ষের পর ভারতের সীমানার ভেতরে কেউ অবস্থান করছে না, আর ভারতের কোনো অংশ দখলও করা হয়নি।
অন্যদিকে সীমান্ত সংঘর্ষের জেরে ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ জোরালো হয়ে উঠছে। এতে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে চীন সরকারের মুখপাত্র গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। তাই শুধুমাত্র ভারতের উপর ভরসা না করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিকল্প বাজারের খোঁজ করতে হবে। এমনভাবেই ভারতে চীনা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছে গণমাধ্যমটি।
এদিকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। স্যোশাল মিডিয়ায় সব শ্রেণী পেশার মানুষই এখন সরব। সবার মুখে একটাই কথা চাই প্রতিশোধ। আবার অনেকে চীনা পণ্য বর্জনেরও ডাক দিয়েছেন। মূলত পুরো ভারতজুড়ে এখন চীন বিরোধী অবস্থা তুঙ্গে। সর্বদলীয় বৈঠকেও একই সুর শোনা গেছে।
উল্লেখ্য, উভয় দেশের ডি ফ্যাক্টো সীমান্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) অতিক্রমে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে চীন ও ভারত। সীমান্ত এলাকায় নিয়ে উভয় দেশের সীমান্ত বিরোধ দীর্ঘ দিনের। আকসাই চীন এলাকাকে জিনজিয়াং প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে আসছে বেইজিং। ১৯৬২ সালে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকা নিয়ে উভয় দেশ ভয়াবহ যুদ্ধে জড়ায়। এতে মৃত্যু হয়েছিল ২ হাজার জনের।
এমএস/এসি