সাম্যবাদীরা করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল
সাব্বির আহমেদ
প্রকাশিত : ১০:১৮ এএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার | আপডেট: ১০:২১ এএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার
যে সকল দেশ সবচেয়ে সফলভাবে করোনা মোকাবেলা করেছে তাদের দিকে তাকালে দেখা যায় যে এরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধারক। উদাহরণঃ চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, কেরালা, শ্রীলংকা, কিউবা, নিউজিল্যান্ড। এই দেশগুলোর করোনা দমন নীতি হচ্ছে, “আগে জীবন, তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য”। নিউজিল্যান্ড সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও এর সরকার চালাচ্ছে জেসিন্ডা আর্ডেনের লেবার পার্টি। এই দলটির মূল নীতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। ঠিক যেমনটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র দুটোই রেখেছিলেন; চেয়েছিলেন সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। গণতন্ত্র ছাড়া সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্র না থাকলে গণতন্ত্র ধনতন্ত্রে পরিণত হয়। যা আমাদের হয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়াও কয়েকটি দেশ করোনা যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ইত্যাদি। এদের ভাল করার প্রধান কারণ হচ্ছে যে এরা করোনার চরিত্র বুঝে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে – “আগে করোনা দমন, তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য” – এমন নীতি গ্রহণ করেছে। তারা শুরুতেই বুঝেছিল যে করোনা দমন করতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। যে কথাটা বোঝেনি সুইডেন।
ইউরোপের সকল দেশ দেরীতে হলেও লকডাউন করেছে; করেনি সুইডেন। লকডাউন না করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কোন লাভ হয়নি। দুনিয়াখ্যাত বৃটিশ সাপ্তাহিক, দ্যা ইকোনোমিষ্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে লকডাউন না করে সুইডেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম বিক্রয় করেছে যা লকডাউন করা প্রতিবেশী দেশ ডেনমার্কের কাছাকাছি।
বাস্তবতা হচ্ছে লকডাউন থাকুক আর না থাকুক, সচেতন মানুষ নিতান্ত বাধ্য না হলে মানুষ ঘরের বাইরে যায় না, নিতান্ত প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য কিছু কেনে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে লকডাউন তুলে দেয়ার পরেও কেনাবেচা তেমন একটা হচ্ছে না। বাংলাদেশও ৪০%-৫০% এর বেশি কেনবেচা করতে পারছে না।
যারা জীবনের আগে ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিয়েছে তারা সকলেই ধরা খেয়েছে। পুঁজিবাদী দুনিয়াতে এদের সংখ্যাই বেশি। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারা না পরেছে ব্যবসা করতে, না জীবন রক্ষা করতে। তাদের আম ও ছালা দুটোই গেছে। লকডাউন তুলে দেয়ার পরেও ঠিকমত চলছে না ব্যবসা-বাণিজ্য। সবার আগে সম্পুর্ণভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে চীন অর্থনীতি খুলে দিয়েছে অনেক আগে। সম্পুর্ণ করোনা মুক্ত হওয়ার পরেও তাদের অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফেরেনি; চলছে ৯০% এর মত।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত পশ্চিমাদের ফলো করতে গিয়ে একই পরিণতি বহন করছে। ব্যবসাও হচ্ছে না, মানুষও মরছে। এপ্রিলের শেষ দিক থেকে লকডাউন তুলে নেয়া শুরু না করলে, গার্মেন্টস খোলার জন্য তাড়াহুড়া না করলে বাংলাদেশ আরও আগেই করোনা যুদ্ধ জয় করে ফেলত। করোনা দমনের আগে লকডাউন তুলে নেয়ায় এখন আমাদের অবস্থা হয়েছে লেজেগোবরে। দিন দিন করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আবার কড়া লকডাউন না করা পর্যন্ত করোনার চূড়া দেখা যাবে না; স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ভোগান্তি শুধু বাড়তেই থাকবে।
চরম পর্যায়ের ধনতন্ত্র চলছে বাংলাদেশে। দিন দিন বেড়ে চলছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। গরীব শোষণ করে এখানে ধনীরা প্রচণ্ড গতিতে আরও ধনী হচ্ছে। ধনতন্ত্রের কাছে প্রেম, প্রকৃতি, প্রাণের গুরুত্ব নেই। ধনতন্ত্র বোঝে শুধু মুনাফা; ধন কিভাবে আরও ধন আনতে পারে সে যুক্তি দেখায়। ধনতন্ত্রে আছে চরম ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নেই সামাজিক দায় বোধ, নেই সহমর্মিতা, নেই সকলে মিলে একসঙ্গে চলার চেতনা। ধনতন্ত্রে সাম্য নেই, বিভেদ আছে।
এই করোনাকালে দরকার ঐক্য, সাম্যের বোধ, দুঃখ-কষ্ট যার যা আছে তা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেবার মানসিকতা। যেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। আবার আমাদের মধ্যে সাম্যের বোধ জাগ্রত করা দরকার। সামাজিক দায়িত্ববোধ বাদ দিয়ে জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য করার মানসিকতা থেকে গ্রহিত করোনা যুদ্ধনীতি ফল দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। করোনা দূর হওয়ার আগে স্বাভাবিক অর্থনীতি ফেরত আসবে না। এ কথা যত আগে নীতি নির্ধারকেরা উপলব্ধি করবেন, সমস্যার সমাধান তত দ্রুত হবে।
ধনতন্ত্র আমাদের উল্টো পথে চালাচ্ছে। বলছে– চাচা, আপনা প্রাণ বাঁচা। প্রশাসকেরা অফিস-আদালত-কারখানা-দোকান খোলা রেখে বলছে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে। করোনা সংক্রমন বাড়িয়ে দিয়ে, সরকারী হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার ব্যবস্থা করে বেসরকারী হাসপাতাল খুলে দিচ্ছে। করোনার যন্ত্রণাকে ব্যবসায়িক পণ্যে রূপান্তর করে দিয়েছে। এমনটা হবার কথা ছিল না। জীবন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সমাজতন্ত্র দিয়ে গেছে। আমাদের সমাজে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা যা ছিল তা আর নেই। সংবিধানে আছে, বাস্তবে নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ধনতন্ত্রীরা আমাদের সমাজতন্ত্রকে, সাম্যের বোধকে যাদুঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা-চর্চা সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। করোনা কোন শ্রেণীর সমস্যা নয়, এটা সমগ্রের সমস্যা। সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রয়োগ ছাড়া মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের মত সামগ্রিক বিষয়গুলো মোকাবেলা করা যায় না। ধনতন্ত্র এগুলোকে শুধু খারাপ থেকে খারাপতর করে তুলতে পারে। দেশে দেশে সাম্যের বাণী নতুন করে ফিরে আসছে। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও সমাজতান্ত্রিক বোধ জেগে উঠছে।
আমাদের সংবিধানিক অধিকার সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন দরকার। বাস্তবায়নের আগে দরকার সকলের মধ্যে সাম্যের বোধ। একা একা ভাল থাকা যায় না। সকলে ভাল না থাকলে আমি একা ভাল থাকতে পারব না–ইতিহাস আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষায় চাই সকলের সমান অংশগ্রহণ। এই অধিকারগুলো আদায় করতে হলে সাম্যের মানসিকতা এবং সাম্যবাদের প্রয়োগ ছাড়া পথ নেই।
লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।
এমবি//