বাবার ভালোবাসা
শামীম আরা খানম
প্রকাশিত : ০৫:৪০ পিএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার
বাবা ও বোনেদের সঙ্গে লেখক
আমরা তিন বোন, পাঁচ ভাই। তিন বোন (ভাইয়েরাও) খুব টক খাই। কারণ আমাদের আব্বা খুব টকজাতীয় ফল খেতে পছন্দ করেন। আর আমাদের আম্মা পছন্দ করেন মিষ্টি। আব্বা সবসময় বাজার থেকে খুঁজে খুঁজে যত রকম টক ফল পাওয়া যায় সব আনতেন। এ জন্য আম্মার অনেক বকা শুনেছেন তিনি। এখনও ডাল-এ টক জাতীয় কিছু না কিছু না দিলে রাগ করে ডাল খান না আব্বা! আমরা বোনেরা প্রতিযোগিতা করে টক ফল খাইতাম। একবার আমার বোন ২৮টা আস্ত জলপাই খেয়েছিল। আমি ১৫টা। আমার ভাইয়েরা কাঁঠাল খেত খুব। একবার বড়ভাই (আমার ছোট) এক বসায় ৬৫টা বড় কোয়া খেয়েছিল!
ছোটবেলায় (কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াকালীন) প্রতি রোববার আব্বা একটা বড় মাছ আনতেন আর সাথে হয়তো গরুর মাংস বা মুরগী। ভাটির রক্তের বলেই হয়তো ছোটকাল থেকেই আমরা তিনবোনই মাছ কাটায় সিদ্ধহস্ত। এটা যে আমাদের শত্রুরাও (?) বলে সে ব্যাপারে আমরা সন্দিহান নই! যে এলাকার মানুষ সকালের নাস্তা হিসেবে ভাত খায়, হাওর থেকে একঠেলা (ঠেলা জাল) ইচা মাছ ধরে এনে সেই তাজা মাছ রান্না করে। এটাকে আমার দ্যাশের ভাষায় বলি ইচা বিরান।
একবার ভৈরব থেকে একটা বিরাট পাকা রুই আনলেন আমার করিম জ্যাঠা যেটা প্রায় ১৬ কেজি ওজনের ছিল। আমরা সব ভাই বোন মিলে সেটা ঘরেই খুব উৎসব করে কোরবানির ছুরি দিয়ে কেটেছিলাম। মাছের পিস এমন হয়েছিল যে খাবার প্লেটের এপাশ ওপাশে ঝুলে পড়েছিল। জীবনে এর চেয়ে বড় মাছ আর কাটিনি। আর খাইওনি।
আব্বা প্রতি রোববারে তাজা মাছ রান্নার নিয়মাবলি বলে দিতেন আর মাছের মাথা রান্না করতে বলতেন মুগডাল দিয়ে। একেক সপ্তাহে আমাদের একেক বোনকে মাছের মাথা খেতে বলতেন! আমরা খুব লজ্জা পেতাম! ভাইদের রেখে কিভাবে এতবড় মাথা খাবো? মন মানতো না। কিন্তু আব্বার এক কথা, আমার মেয়েরা বিয়ের পর কোন ঘরে যাবে, সেখানে যদি ওদেরকে মাছের মাথা খেতে না দেয়? আমার পাঁচভাই একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেনি কখনো। সেই থেকেই আমাদের তিন বোনের মাছের মাথা খাবার অভ্যাস হয়েছিল।
আলহামদুলিল্লাহ! আজও আমাদের তিন বোনের জামাইরা এই কথা মনে রেখে আমাদেরকে মাছের মাথা খাওয়ায়, আব্বার স্নেহ আর ভালোবাসাকে সম্মান দিয়ে। ভাইয়েরা, ওদের বউরাও বাবার বাসায় দাওয়াতে বোনদেরকে মাথা খেতে দেয়, সেটা যে মাছই হোক না কেনো? এখানে আরেকটি বিষয় বলে নিই, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের এখনো একান্নবর্তী পরিবার।
আমার জামাই, মেয়েদেরকে মাথা খাওয়াতে চায় কিন্তু ওরা মোটেই কোনো মাছের মাথা খায় না। তবুও জোর করে ভেঙে ঘাড়ের কাছের অংশ একটু খাওয়ায় আর বলে- এভাবেই তোমার নানাভাই তোমার মা খালাদের খাইয়েছে। মেয়েদের বাবা যে কোনো মাছ নিজের প্লেট থেকে তুলে কাটা বেছে মেয়েদেরকে একটু করে মুখে তুলে খাইয়ে দেন। বড় বোনের মেয়েও তাই, আর ছোটো বোনের দুই ছেলে। ওরা মাছ খায়, মাথা খায় না। মেয়েদের প্রতি বাবাদের ভালোবাসার সেই ধারাবাহিকতা যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে আর ভবিষ্যতেও চলবে।
এখানে বলে নিই, আমার বাবা সোনালী ব্যাংকের জিএম ছিলেন। ২০০০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বয়স এখন ৭৯ বছর ৩ মাস ২০ দিন। আলহামদুলিল্লাহ, সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়েন। দিনে তিন/চার বার বাজারে যান। আম্মার বকা গ্রাহ্য না করেই!
পৃথিবীর সব বাবাদের জন্য রইলো অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ভালো থাকুন সবার বাবা।
লেখক- বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এমবি/এনএস/