ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ২১ ১৪৩১

আমার বাবা ‘লেহা ভাই’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৫৮ পিএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার

মাসুদ করিম ও তার বাবার কবর।

মাসুদ করিম ও তার বাবার কবর।

বাবা একটি মধুর নাম। কত কষ্ট করে তিনি আমাদের লালন-পালন করেন। আদর করেন, ভালোবাসেন। আমাদের আহার অন্বেষণ করেন। সারাদিন কাজ শেষে ফিরে পরিবারে সময় দেন। শত কষ্টের পরও কাউকে বুঝতে দেন না তার কষ্ট। গোপনেই থেকে যায় সেই কষ্ট। সেই বাবাকে স্মরণ করেই আজকের এই দিনে পালন করা হয় ‘বিশ্ব বাবা দিবস’।

যাদের বাবা আছে, তারা এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নানা আয়োজন করে থাকেন। আর যাদের বাবা নেই তারা অনেকেই তাদের বাবাকে নিয়ে নানান ধরনের স্মরণীয় ঘটনা লিখে থাকেন। তেমনি বাবা হারানোর ব্যথা নিয়ে বাবাকে স্মরণ করে স্মৃতিচারণ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক দৈনিক যুগান্তরের প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম।

বাবাকে নিয়ে লেখা নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসটি একুশে টেলিভিশন-এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘আমার ছে‌লে‌বেলায় আমা‌দের গ্রা‌মে যাত্রাপালা খুবই জন‌প্রিয় ছিল। রুপবান না‌মের যাত্রা দেখার জ‌ন্যে মঞ্চায়‌নের আগ থে‌কে গ্রা‌মের লোক‌দের ম‌ধ্যে রব উঠে যেত। ওই সম‌য়ে আমা‌দের গ্রা‌মে আমার বাবা ছাড়া লেখাপড়া জানা কোনও লোক ছি‌ল না। তাই গ্রা‌মের যুবকরা যাত্রাপালা কর‌তে গি‌য়ে বিপা‌কে পড়‌তেন। যাত্রার বই প‌ড়ে দেয়ার কেউ ছিল না। আমার বাবা‌কে বই পড়ার জ‌ন্যে ডে‌কে নি‌তেন।

গ্রা‌মের লো‌কেরা তা‌কে "‌লেহা ভাই" ব‌লে ডাক‌তেন। বাবার আসল নাম মো. মোফাজ্জল হো‌সেন। ত‌বে সবাই লেহা ভাই না‌মে চিনত। কারণ তি‌নি একমাত্র লেখাপড়া জানা‌ লোক। নন মে‌ট্রিক পর্যন্ত লেখাপড়া ক‌রে‌ছেন, মে‌ট্রিকু‌লেশন মা‌নে এসএস‌সি পরীক্ষা দেন‌নি কিংবা পাশ করেন‌নি। যাত্রাপালার তি‌নি ছি‌লেন ফ্রমমাস্টার। যাত্রার বই পড়‌তেন আর তা শু‌নে  অভিনেতারা ম‌ঞ্চে পারফর্ম কর‌তেন।

নন মে‌ট্রিক হ‌লেও বাবার সব বিষ‌য়ে জ্ঞান ছিল। পেশায় তি‌নি কৃষক ছি‌লেন। দিনভর মা‌ঠে গরুর লাঙ্গ‌লে হাল চাষ থে‌কে শুরু ক‌রে কুড়াল দি‌য়ে লাক‌রি সংগ্রহ সবই তি‌নি ক‌রে‌ছেন। আমার ম‌নে আছে, বাবা আমার চুল কে‌টে দি‌তেন, সব সম‌য়েই রাউন্ডছাট, মা‌থার চার‌দি‌কে ‌গোল ক‌রে চুল কাটা। আমি খুব অপছন্দ করতাম।

আমা‌দের বা‌ড়ি‌তে পা‌শের গ্রা‌মের র‌ঞ্জিত না‌মের একজন নরসুন্দর আস‌তেন, তার হেয়ার স্টাইল আমার পছন্দ হ‌লেও অর্থ সাশ্রয় কর‌তে বাবা জোর ক‌রে নি‌জে আমার চুল ছে‌টে দি‌তেন। তার অন্য সন্তান‌দেরও তাই কর‌তেন। আমার বাবার পাঁচ ছে‌লে ও চার মে‌য়ে। দুই ছে‌লে ইতিম‌ধ্যে মারা গে‌ছেন। বাবা মারা যান ১৯৯৯ সা‌লে।

সারা‌দিন ক‌ঠোর প‌রিশ্রম করার পর চাঁদ‌নি রা‌তে আমা‌দের বা‌ড়ির উঠা‌নে গ্রা‌মের লো‌কেরা সবাই সম‌বেত হ‌তেন । আমা‌দের বা‌ড়ি‌তে ছিল কাসাসুল আম্বিয়া না‌মের বই। এতে আম্বিয়া‌দের জীবন কা‌হিনী কা‌ব্যিক ঢং‌য়ে লেখা ছিল। বাবা সুর ক‌রে বইটি থে‌কে পড়‌তেন, কারবালার বি‌য়োগান্তর কা‌হিনী, পড়ার সম‌য়ে সমবেত কেউ চো‌খের পা‌নি ধ‌রে রাখ‌তে পার‌তেন না ।

বাবা ছি‌লেন সরল‌সোজা মানুষ। বৈষ‌য়িক চিন্তা তার ছিল না। তি‌নি সংসা‌রের জ‌ন্যে গাধার খাটু‌নি খে‌টে‌ছেন। তার উপার্জ‌নে জ‌মি কেনা হ‌লেও তার রে‌জি‌স্ট্রি আমাদের না‌মে আর মা‌য়ের না‌মে ক‌রে‌ছেন। আমা‌দের ভাইবোন‌দের লেখাপড়া করা‌নোর, সংসার কীভা‌বে চল‌বে সবই দেখ‌তেন মা। বাবা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছি‌লেন। তি‌নি নামাজ পড়‌তেন, আজান দি‌তেন। আমা‌দের গ্রা‌মের নাম কদম দেউ‌লি, থানা বারহাট্টা, জেলা নেত্র‌কোনা। আমা‌দের পাশ্ববর্তি দেউ‌লি গ্রা‌মের বে‌শির ভাগ হিন্দু সম্প্রদা‌য়ের লোক। তা‌দের স‌ঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব ছিল।

বাবা আমা‌দের খুব ভালবাস‌তেন। তাই স্ত্রী সন্তান‌দের রে‌খে কোথাও যে‌তেন না। মা মা‌ঝে মা‌ঝে ঝগড়া কর‌তেন তাব‌লিগে যাওয়ার জন্য। বাবা তাব‌লিগ পছন্দ কর‌তেন না। আমা‌দের পাশ্বব‌র্তি আরেক গ্রা‌মের নাম সতরশ্রী। ওই গ্রা‌মে আকবর আলী রেজভী না‌মের একজন পীর ছি‌লেন। তি‌নি তাব‌লিগ পছন্দ কর‌তেন না। বাবা ছি‌লেন ওই পী‌রের ভক্ত। ত‌বে তাব‌লি‌গের লো‌কেরা তা‌কে দাওয়াত দি‌তে এলে তা‌দের স‌ঙ্গে বিন‌য়ের স‌ঙ্গে কথা বল‌তেন ।

মারা যাওয়ার আগে বাবা খুব অসুস্থ ছি‌লেন। ওই সম‌য়ে আমি ঢাকায়। বাংলাবাজার প‌ত্রিকায় জু‌নিয়র রি‌পোর্টার। আমি কখনই ভা‌বি‌নি তি‌নি মারা যা‌বেন। তাই ভে‌বে‌ছিলাম ক‌য়েক‌দিন পর বা‌ড়ি যাব, বাবার সেবা করব। কারণ বাবা আমার ঢাকায় থাকা পছন্দ কর‌তেন না। তি‌নি চাই‌তেন আমিও যেন তার সব সন্তা‌নের ম‌তো বা‌ড়ি‌তে থা‌কি। অসুস্থ থাকার দিনগু‌লো‌তে বার বার বল‌তেন আমি যেন বা‌ড়ি চ‌লে যাই। আমি ভাব‌তেও পা‌রি‌নি বাবা আমা‌দের ছে‌ড়ে চ‌লে যা‌বেন।

বাংলাবাজা‌রে আমার চিফ রি‌পোর্টার মোল্লাহ আমজাদ হো‌সেন এক‌দিন আমা‌কে বল‌লেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনা সুন্দরবন যা‌চ্ছেন। সুন্দরবন‌কে বিশ্ব ঐ‌তিহ্য ঘোষণা ক‌রে‌ছে ইউনে‌স্কো। তার উদ্বোধন। হে‌লিকপ্টা‌রে সাংবা‌দিক নি‌য়ে যা‌বেন। মোল্লাহ ভাই আমা‌কে ওই ট্রি‌পে যে‌তে বল‌লেন। আমার পোশাক প‌রিচ্ছদ এত ভাল না। প্রধানমন্ত্রীর স‌ঙ্গে যে‌তে হ‌লে ভাল পোশাক দরকার। মোল্লাহ ভাই আ‌মা‌কে কিছু টাকা দি‌লেন জামা কেনার জন্য।

জু‌নিয়র রি‌পোর্টার হিসা‌বে প্রধানমন্ত্রীর স‌ঙ্গে হে‌লিকপ্টা‌রে সুন্দরব‌নের ম‌তো জায়গায় যাওয়া একটা বিরাট সু‌যোগ। আমার কেন জা‌নি যে‌তে ভাল লাগ‌ছিল না। আমি টাকাটা মোল্লাহ ভাইকে ফেরত দি‌য়ে বললাম, আমি যাব না। মোল্লাহ ভাই তখন আমা‌দের আরেক সহকর্মী শাবান মাহমুদ‌কে ওই ট্রি‌পে যে‌তে ব‌লেন । শাবান মাহমুদ খু‌শি‌তে আত্মহারা। তি‌নি তখন ছাত্রলী‌গের রাজনী‌তি‌তে স‌ক্রিয়।

শেখ হা‌সিনার স‌ঙ্গে যাওয়ার সু‌যোগ তার জ‌ন্যে বিশাল ব্যাপার। শাবান ভাই সুন্দরবন গে‌লেন। সুন্দরবন থে‌কে প্রধানমন্ত্রী ফি‌রে গে‌লেও সাংবা‌দিকরা বেশ ক‌য়েক দিন সেখা‌নে থাক‌লেন। প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন যাওয়ার প‌রের দিন আমার ডে অফ।

আমি তখন ব্যা‌চেলর। আমি আর আমার ভা‌গ্নে শ‌ফিউল আলম দোলন মুগদাপাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া ক‌রে থা‌কি। ডে অফের দিন কী ম‌নে ক‌রে বিকাল পাঁচটার দি‌কে অফি‌সে গেলাম। মোল্লাহ ভাই আমাকে কিছু টাকা দি‌য়ে বল‌লেন তাড়াতা‌ড়ি বা‌ড়ি যাও তোমার বাবা অসুস্থ। তোমার বা‌ড়ি থে‌কে ক‌য়েকবার ফোন এসেছে। আস‌লে তখন বাবা মারা গে‌ছেন। ১৯৯৯ সা‌লের ঘটনা। তখন আমার মোবাইল ছিল না ব‌লে জানা‌তে পা‌রে‌নি। তেঁজগাও‌য়ে বাংলাবাজার অফিসের কা‌ছে মহাখালী গি‌য়ে বা‌সে উঠলাম। রাত ১১ টায় নেত্র‌কোনো পৌঁছলাম।

নেত্র‌কোনা থে‌কে আমার বা‌ড়ি ২০ কি‌লো‌মিটার দূ‌রে। এত রা‌তে কীভাবে যাব! আমি তখন ‌নেত্র‌কোনায় আমার এক বন্ধু নেত্র‌কোনা সরকারী ক‌লে‌জের সা‌বেক ভি‌পি গাজী মোজা‌ম্মেল হক টুকুর বাসায় যাই। আমা‌কে দে‌খে টুকু আমার বাবার মারা যাওয়ার খবর জানাল। সে আমা‌কে তার মোটরসাইকেলে রা‌তে বা‌ড়ি পৌঁছে দিল। আমি সে‌দিন অজানা কার‌ণে সুন্দরবন যাইনি ব‌লে বাবার জানাজায় শ‌রিক হ‌তে পে‌রে‌ছিলাম।

অকার‌ণে ডে অফ অফিসে যাওয়ায় বাবার মরা মুখটা অন্তত দেখ‌তে পে‌রে‌ছিলাম। দুই দশক আগে বাবা চ‌লে গে‌লেও এখনও শূন্য শূন্য লা‌গে। আমি নি‌জে বাবা হওয়ায় সন্তা‌নের প্র‌তি বাবার দরদ খুব বে‌শি অনূভব ক‌রি। সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া কর‌বেন।

লেখক- জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এনএস/