বাবা, ভালোবাসি তোমায়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:১৮ পিএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার | আপডেট: ১২:০৪ এএম, ২২ জুন ২০২০ সোমবার
বাবা সন্তানের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়ার মতো, যাঁর স্নেহ অবারিত ধারায় শুধু ঝরতেই থাকে। শিশু সন্তান তার কচি হাত দিয়ে বাবার হাতটি আঁকড়ে ধরে তাদের অটুট সম্পর্ক জানান দেয়। বাবা মানে ভরসা। বাবা মানে বৃক্ষ। বাবা হলেন অনন্য আলো, যার আলোয় আলোকিত হয়েই আমাদের প্রতিনিয়ত পথচলা। বাবা শব্দটি এমন একটি অনুষঙ্গ যার সাথে জড়িয়ে আছে স্নেহ আর মমতার এক মায়াবী বিশালত্ব। বাবা শাশ্বত, বাবা চির আপন। মাথার উপর আকাশ যেমন পৃথিবীর জন্য ছাদ, একজন সন্তানের জীবনে বাবা তেমন পরম আশ্রয়। পরম আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।
আমার কাছে বাবা মানে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে যিনি সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে জীবিকার সন্ধানে বেড়িয়ে পড়েন তিনিই বাবা। রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, নিজের শ্রমে-ঘামে নিঃশেষ করার অপর নাম বাবা। হাজারো কষ্ট সয়ে সন্তানকে নিরাপদ বলয়ে রেখে মানুষ রূপে গড়ে তোলেন যিনি তিনিই বাবা। বাবা মানে একটু গম্ভীর স্বরে সন্তানের শাসন বারণের নাম। অপর দিকে গোপনে কোমল হৃদয়ে সন্তানের প্রতি গভীর টান অনুভব করার নামও কিন্তু বাবা। পৃথিবীর প্রত্যেক বাবা নিজের মতো করে অনন্য। এটা সৃষ্টির ধরন। হাদীসে আছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।’(তিরমিযি-১৮৯৯)। বাবা হলেন আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তান বাবার ঋণ কখনো পরিশোধ করতেও পারে না। আর এই না পারার কারণেই বাবার সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবন।
আজ বাবা দিবস। তাই বাবাকে নিয়ে দু’কলম লেখার অভিপ্রায় জেগেছে। আমার বাবার নাম কাজী মোশাররফ হোসেন জসিম। বাবার প্রতি এতোটাই ঋণী যে,কখনো মনে হয়নি কিছুটা শোধ করি। যার কাছে এত ঋণ, তার ঋণ শোধ করার ইচ্ছে জাগে না,আর সেটা সম্ভবও না। বাবা দিবসে বাবাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার ইচ্ছে নেই, কারণ আমি প্রথা বিরোধী মানুষ। স্রোতে গা না ভাসিয়ে চলা মানুষ। তবুও কেন যেন বাবা দিবসকে এবার অন্যরকমভাবে অনুভব করছি। এবার এমন এক সময়ে বাবা দিবস এসেছে, যখন মরণব্যাধি করোনা বাবা-মা সন্তানদের সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। বহু সন্তান তার পিতা-মাতাকে রাস্তায় ফেলে গেছে। লাশ ফেলে গেছে পথে প্রান্তরে। এসব উদাহরণ দেখে রুষ্ট হয়েছি। চিরন্তন এ মায়ার বাঁধন ফেলে যারা দূরে যেতে পারে,তাদের সম্পর্কে কী বা বলবো?
বহু-বছর ধরে তিনি জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন তিনি। এখন দেশে থাকছেন। বাবার প্রবাস জীবন প্রথম শুরু আশির দশকের শেষ দিকে। পাড়ি জমান মধ্য প্রাচ্যের দেশ কাতারে। এরপর দীর্ঘদিন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছিলেন দীর্ঘদিন। আমাদের প্রতি বাবার ভালোবাসা কেমন তাঁর ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ছোটবেলার এই সুখস্মৃতি মনে পড়লে আবেগ প্রবণ হই। তখন আমার বয়েস তিন কী চার। কাতার থেকে বাবা চিঠি লিখেছেন আমার দাদা (কাজী মোহাম্মদ সাঈদ) সাহেবকে। চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি দেশে আসবেন; কার কী লাগবে সেটা চিঠিতে জানাতে। আমি তখন নাকি টেলিভিশন আনতে বলেছিলাম। তার একটা কারণ হচ্ছে, নানুর বাড়িতে গেলে টেলিভিশন দেখতাম। দাদু আমার আকাঙ্ক্ষার কথা বাবাকে জানালেন।
এরপর কিছুদিন পর বাবা দেশে এলেন। রঙিন টেলিভিশন নিয়ে! টেলিভিশন নিয়ে বা কী লাভ হল? সন্দ্বীপে তো বিদ্যুৎ নেই। যদিও আজ অবধি জিজ্ঞেস করিনি যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে রঙিন টেলিভিশন কেনার অর্থ কী ছিল?-তবে এটাই অনুধাবন করছি যে,জীবনে আমার মুখ থেকে প্রথম ইচ্ছার কথা প্রকাশ হওয়া মাত্রই তিনি সেই আবদার পূর্ণ করলেন। এটার আনন্দ হয়তো তিনি রাখার জায়গা পাননি। সেই শৈশব থেকেই টিভির প্রতি আমার একটা প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল, যার জন্য পেশাগত কারণে হোক আর সক্রিয়তার কারণে হোক, আমি আজ দেশের প্রথম বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে কাজ করছি।
প্রবাসী বাবার সন্তান হওয়ার এক অন্যরকম আনন্দ ও বেদনার মিশ্র অনুভূতি আছে। দিনের পর দিন বাবাকে দেখি না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি এক বুক প্রতীক্ষা নিয়ে। তারপর অনেক দিন পর এত প্রতীক্ষার পর বাবা আসতেন। এত আগ্রহের পর বাবাকে সামনে দেখে সব কেমন যেন গুলিয়ে যেত। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বাবা আমাদেরকে কোলে নিতেন। প্রবাসী বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত টাকা তিলে তিলে জমিয়ে রাজ্যের সুখ কিনে আনতেন আমাদের জন্য। সেই সুখ আমরা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। হয়তো সেই চাকচিক্যের মধ্যে বড় হয়েছি বলেই আজ আর কোনো চাকচিক্য,কোনো জৌলুস আমাদেরকে টানে না। বাবা তাই বলেন। বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা ছোট থেকে অনেক চাকচিক্য দেখে বড় হয়েছে। চাকচিক্য তাদেরকে টানবে কেন?
টানেনি সত্যি। এসএসসি দিয়ে যখন ঢাকায় চলে এলাম। গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। বন্ধুরা যখন এসএসসির পর চট্টগ্রাম শহরের স্বপ্নে বিভোর, আমি তখন এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বাবাকে বলেছিলাম, ঢাকায় পড়তে চাই। বাবা কারো কথা শোনেননি, কোনোদিকে তাকাননি। বুকের পাথর বুকে চেপে আদরের ধনকে ঢাকায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ ছাড়তে না ছাড়তে এই শহরকে জড়িয়ে নিয়েছি আপন আলয় হিসেবে। বাবা-মাকে ছেড়ে এ শহরের কাটছে আমার নিত্য দিন। মন পোড়ে কিন্তু এই দহন কেবল আমি উপলব্ধি করি। চোখের সীমানায় প্রিয়জনদের না দেখে যখন অশ্রুসিক্ত হই তখন পুরনো স্মৃতি আমায় শক্তি দেয়। বাবা মায়ের অভাব অনুভব করি প্রতিদিন প্রতিনিয়তই।
শহরের সবটুকু সুখ বাবা আমাকে কিনে দিতে চেয়েছিলেন তার সীমিত সাধ্যের মধ্যেও।পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে কখনো আপোষ করেননি। তবু আমার মনে হয়েছিল,বড্ড ভারী বোঝা দিয়ে ফেলেছি বাবাটার কাঁধে। তাই বাবার কড়কড়ে টাকার উপরে পা রেখে শহরের লাল-নীল আলোয় আমি হারিয়ে যাইনি। বরং বাবার শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে সততা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নের পথে হেঁটেছি। ওই যে বললাম, চাকচিক্য দেখে বড় হয়েছি বলেই শহরের চাকচিক্য আর টানেনি আমাকে। সব সুখ বিসর্জন দিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়ার কাঁটা বিছানো পথ বেছে নিয়েছি।
আমার বাবা যে কতটুকু অন্যরকম বাবা,তার আরেকটা উদাহরণ দিই। যখন সবাই চায় ছেলে মোটা টাকা আয় করুক,ঝলমলে ক্যারিয়ার গড়ুক,আমার বাবা একটিবারও তা বলেননি। আমি পরিবারকে অনেক আগেই জানিয়েছিলাম আমি মিডিয়ায় কাজ করতে চাই। দেশ ও দশের সেবা করতে চাই। আমার বাবা দ্বিতীয়বার প্রশ্ন না করে আমার ইচ্ছে মেনে নিয়েছেন। একটিবারও সবার মতো বলেননি, এটা পিচ্ছিল পথ। ঝুঁকির পথ। অথচ যেখানে আমাকে এসব বলে যারা একদিন ভয় দেখাতো আজ তারাই আমাকে বাহবা দেয়। এমন কি আমি যখন কলেজ জীবনে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুললাম সেটার শুরুটা ছিল বাবার টাকায়। পৃথিবীতে ঠিক ক'জন বাবা আছেন যারা কোন বাঁধা-বিপত্তি ছাড়াই সন্তানের এমন স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে আমার মা, ভাই বোন, দুই চাচার ভুমিকা অসামান্য।
আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়েছি,কারণ আমার বাবা কখনও আমার হাত ছেড়ে দেননি। বাবার সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা আজকে হঠাৎ করে মনে পড়লো। আমার জীবনে বাবার কাছে যা কিছু চেয়েছি,তার একটিও অবশিষ্ট রাখেননি তিনি। সন্তান হিসেবে তাঁর কাছ থেকে প্রতিটি অধিকার আমার অর্জিত হয়েছে। বিনিময়ে এখনো কিছুই দিতে পারিনি। সেসব নিয়ে বাবার কষ্ট নেই, তবে প্রতিষ্ঠিত সন্তানের চেহারা দেখার আনন্দ বাবাকে ভীষণ গর্বিত করে। আমার কারণে আমার বাবা-মা সম্মান পেলে,আমি হৃদয়ে খুব শান্তি অনুভব করি কিন্তু কখনও মুখ ফুটে বলি না তাদের কত ভালোবাসি।হৃদয়ের গহীনে ভালোবাসার অজস্র স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে পরিবার-পরিজন আর বাবা-মায়ের প্রতি। অত্যন্ত ভালোবাসায় যার বেড়ে ওঠা,তার কাছে ভালোবাসার কোনো বিকল্প হতে পারে না। তাই এই ভালোবাসা কেবলই সীমাহীন। ভালোবাসি কথাটা বাবাকে কেউ বলে না। কী এক অদৃশ্য সংকোচ বলতে দেয় না। আমিও বলতে পারিনি। কিন্তু সব কথা মুখ ফুটে বলার দরকার হয় না। বাবা তো সেই মানুষ, যিনি চোখ পড়ে বুঝে নিতে পারেন কতটুকু ভালোবাসি। ভালোবাসার আদান-প্রদানটা না হয় চোখের ভাষাতেই হোক।
লেখক- প্রতিবেদক, একুশে টেলিভিশন