ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

একজন রোটারিয়ানের অস্বাভাবিক প্রয়াণের দায় কার…

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ১০:২০ পিএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার

রোটারিয়ান নাথুরাম নাথ

রোটারিয়ান নাথুরাম নাথ

মানুষ মরণশীল,সকল মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়।কিন্তু মৃত্যুটি যখন হয় অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত তখন তা কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। একজন ঘনিষ্টজন যখন আইসিইউ ও অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে,তখন তা কেমন হৃদয়বিদারক-তা শুধু আপনজনেরাই উপলব্ধি করতে পারে। চট্টগ্রামের আইসিইউ সুবিধা আছে এমন ১২টি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছি কিন্তু তারা ভর্তি করতে নারাজ। কেউ কেউ বলছে খালি নেই। রয়েল হাসপাতালে মুঠোফোনে আইসিইউ সুবিধা আছে কি-না জিজ্ঞেস করা হলে বলা হয়,আইসিইউ সুবিধা আছে, তবে বন্ধ। কেন বন্ধ জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর নেই।

ওদিকে আমার রোগীটি ইউএসটিসি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করছে। বাইরে থেকে এনে অক্সিজেন যা দেয়া হচ্ছে,তা পর্যাপ্ত নয়।আইসিইউ সুবিধা আছে-এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রোগীর স্বজনদের তাগাদা দিচ্ছেন ইউএসটিসি’র চিকিৎসকেরা।রোগীর স্বজনেরা মুঠোফোনে আমাকে আইসিইউ সুবিধা আছে-এমন হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থার জন্যে অনুরোধ করলেও পরিচিত এতো রথি-মহারথি থাকতে দিনভর আপ্রাণ চেষ্টা করেও চট্টগ্রামের কোনো আইসিইউ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হয়েছি।সর্বশেষ রাজধানীর আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচিত এক চিকিৎসকের মাধ্যমে ভর্তির বিষয় চূড়ান্ত করা হলেও ঝুঁকি বিবেচনায় ঢাকা নেয়া হয়নি।১৯জুন ২০২০ দিবাগত রাত ৪টার দিকে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে পরলোকগমন করেন আমাদের প্রিয়জন রোটারি ক্লাব চিটাগং হিলটাউনের সদস্য রোটারিয়ান নাথুরাম নাথ(৭০)।মরণের আগেই বিনাচিকিৎসায় মরে যাওয়ার এ ঘটনা আমাকে মানসিকভাবে ভীষণ আঘাত দিয়েছে-যা আজীবন মনে থাকবে।আমি প্রয়াত নাথুরামের পরমাত্মার প্রশাস্তি প্রত্যাশা করছি।

নাথুরাম নাথ ১৯৫০ সালের ১০এপ্রিল সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের দক্ষিণ মাহমুদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা চপলা বালা দেবী, বাবা শ্রী হরিনাথ।ষাটের দশকে তাঁর মা বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন।বাবা ছিলেন একই ইউনিয়নের মেম্বার।১৯৬৮ সালে তিনি মসজিদ্দা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৭১ সালে সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টামিডিয়েট পাশ করেন।মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে চলে গেলে প্রতিবেশি একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের জায়গাজমি দখলে নিয়ে যায়।স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে  নাথুরাম দখলকৃত সহায়সম্পদ উদ্বার করতে যেয়ে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে যান।এতে করে তাঁর আর লেখাপড়া হয়ে ওঠেনি। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের তিনি সহ-সম্পাদক ছিলেন।৬৯এর গণঅভ্যুল্থান থেকে শুরু করে ৭০এর নির্বাচন,পরবর্তীতে জাতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখেন।বিশেষকরে সীতাকুণ্ডের বিগত প্রতিটি এমপি-উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের ক্ষেত্রে অর্থ-শ্রম-মেধা দিয়ে অবদান রেখেছেন। বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের তিন-তিনবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান রহমত উল্যাহ যখন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন(১৯৮৩)তিনি ওই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।ওইসময়ে নাথুরাম ছিলেন রহমত উল্লাহ চেয়ারম্যানের পরিষদে মেম্বার।দলে বড়কোনো পদ-পদবীতে না থাকলেও আওয়ামী লীগ ও এর ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতেন।

নাথুরাম সনাতনধর্মী হলেও মনেপ্রাণে তিনি অসাম্প্রদায়িক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাধুপুরুষ।দান-অনুদানের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে কোনো বাছ-বিচার নেই।মসজিদ-মন্দির সবখানেই সমানে তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। বহু মুসলিম পরিবারের সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া ও বিয়েশাদিতে তিনি আমৃত্যু সহায়তা দিয়েছেন।নডালিয়ার জনৈক হাফিজুর রহমানের আমৃত্য পারিবারিক যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করেন। এছাড়া এলাকার আরও অনেকে বিপদে পড়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে এসে আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন।তিনি যে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক তা কিন্তু নয়।তবে তাঁর কাছে যা আছে-তা থেকে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত গরীব-দুঃখী মানুষকে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।অসহায় ও নিরীহ মানুষের জন্যে কিছুএকটা করতে পেরে তিনি মানসিক প্রশান্তি খোঁজে পেতেন।

শুধু সীতাকুণ্ড নয়, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক সহযোগিতা করে আসছেন।১৯৮৯ সালে বরিশালের সুবল গোস্বামী ‘শ্যামরাই প্রভুর আশ্রম’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে নাথুরাম তাঁর নিজএলাকা চারালকান্দিতে জমি ও অর্থ দিয়ে তা প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহায়তা  করেন। শ্যামরাই প্রভুর আশ্রম এর পাশে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন দুর্গামন্দির।বাড়বকুণ্ডের নডালিয়া কামিল জমাদার ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাসহ ভুলাইপাড়া জামে মসজিদ স্থাপনে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন–যা ডা. আমজাদ হোসেনসহ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।এছাড়া বাড়বকুণ্ডের সাহাপাড়া রক্ষাকালী বাড়ি,বাড়বকুণ্ড বাজার জামে মসজিদ, দাড়ালিয়াপাড়া জামে মসজিদ, মীরসরাইয়ের আবুতোরাব জগন্নাথ মন্দির, ফেণীর রক্ষাকালী বাড়ি, পটিয়ার উত্তর ভাটিখাইন নাথপাড়া জগদীশ মহাজনের বাড়ির শ্রীশ্রী লোকনাথ সেবাশ্রম, দক্ষিণ কাট্টলী’র হরিমন্দির, নডালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অলিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাউজানের চিকদাইর আলীমুদ্দিন সওদাগর জামে মসজিদ, ফটিকছড়ির সুন্দরপুলের ইঞ্জিনিয়ার মুস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী জামে মসজিদ ও বাড়বকুণ্ড উচ্চবিদ্যালয়কে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।বাড়বকুণ্ডের নডালিয়া সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিকও তিনি জমি দিয়ে প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।

নাথুরাম এলাকার বাড়বকুণ্ড সি সি সি উচ্চবিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি, শ্রী শ্রী নায়ায়ণ আশ্রম পরিচালনা পর্ষদের কার্যকরী সভাপতি, সীতাকুণ্ড টোল কমিটির সদস্য, সীতাকুণ্ড সমিতি-চট্টগ্রাম ও বাড়বকুণ্ডের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াসংগঠন কাকলী’র আজীবন সদস্যসহ বহু সমাজসেবী সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

নাথূরাম একজন মানবদরদী মানুষ। সমাজের অবহেলিত মানুষের চিকিৎসাক্ষেত্রেও তিনি অবদান রাখছেন। বিশেষকরে বারৈয়াঢালা নারায়ণ আশ্রমের সভাপতি হিসেবে তাঁরই উদ্যোগে লায়ন্স ক্লাব ও অন্যান্য সমাজসেবী সংগঠনের সহায়তায় প্রতিবছর চক্ষশিবির করে বিপুলসংখ্যক মানুষকে তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। এছাড়া তিনি আশ্রমে একটি মাতৃসদন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে সকল ধর্মের মানুষকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনার চিন্তাভাবনা করছেন। 

ব্যক্তিগতজীবনে নাথুরাম চট্টগ্রামের সেলিম এন্ড ব্রাদার্স লিমিটেডে এর এস্টেট ম্যানেজার ছিলেন।তাঁর সহধর্মিনী মিনতিপ্রভা দেবী একজন গৃহবধূ।তাঁরা চারকন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জনক-জননী।কন্যারা হলেন- লিপিকা রাণী দেবী (গৃহবধূ), শিল্পী রাণী দেবী (গৃহবধূ), বাণি প্রভা দেবী (গৃহবধূ) ও প্রিয়াঙ্কা রাণী দেবী। প্রিয়াঙ্কা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিডেটে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন।একমাত্র ছেলে নারায়ণ দেবনাথ ইউএসটিসিতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছে।

লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম

আরকে//