আনন্দবাজারের ভ্রম!
মানিক মুনতাসির
প্রকাশিত : ০৭:৫৯ পিএম, ২৩ জুন ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:২৭ পিএম, ২৪ জুন ২০২০ বুধবার
আটার'শ শতকের বাংলা ভাষার কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখে গেছেন- ‘চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে। কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।’ এটাকে আরো সহজ করে বলা যায়- সাপের কামড় না খেলে কেউ কখনো তার বেদনা বুঝতে পারে না। আর আমাদের বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন- আমরা সবাই পাপী; আপন পাপের বাটখারা দিয়ে; অন্যের পাপ মাপি!!
যাইহোক, এবার মূল কোথায় আসি। আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রচারিত একটি পত্রিকা। পৃথিবীর ইতহাসে আর কোন বাংলা পত্রিকা সে অবস্থানে যেতে পারবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অথচ কয়েক দিন আগে ভারত-চীনের বৈরি সম্পর্কের পাপ ঢাকতে পত্রিকাটি বাংলাদেশকে নিয়ে চরম কটাক্ষ করেছে। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর তীব্র প্রতিবাদও হয়েছে। যার প্রক্ষিতে তারা আজ একটি সংশোধনী দিয়েছে। সেখানে তারা ‘ভ্রম সংশোধনী’ শব্দ ব্যবহার করেছে। এটা ভাল যে, দেরিতে হলেও আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সেটা নিশ্চয়ই বড় বিষয়। কেননা ভুল সবাই করে কিন্তু সবাই নিজের ভুলটা ধরতে পারে না। ধরতে পারলেও স্বীকার করেন না। পত্রিকাটি সেটা করেছে।
ভারত নিশ্চয়ই আমাদের অকৃত্র্রিম বন্ধু। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে থাকার সময় দেশটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে। যা দু'দেশের বন্ধুত্বকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে ইন্দিরা গান্ধী যা করেছেন, সেটা অবশ্যই বাংলাদেশও মনে রেখেছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। এজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ভারতের নামও।
ভারত একটি বিশদ দেশ। তাদের ইকনোমি বড়। লোকসংখ্যাও আমাদের তুলনায় প্রায় ৬ গুণ। জনসংখ্যার ভিত্তিতে তাদের উন্নতি কতটা সেটা এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়। তবে আমাদের উন্নতিটা তাদের সহ্য হয় না এটা খুবই সত্য। এজন্য হয়তো নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ক্ষতিকর দিকটা ঢাকতে গিয়ে বাংলাদেশকে কটাক্ষ করেছে। অন্যদিকে, চীন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীক বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগী। চীনের ঋণ, প্রযুক্তিগত সহায়তাসহ নানা ধরনের সহয়তায় আমাদের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনোই খারাপ ছিল না। ভারতও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটাও সত্য যে, প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকে। এতে ভারত কত টাকার ব্যবসা করে সে হিসাবটা আমাদের চেয়ে ভারত সরকারই ভাল বলতে পারবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় রয়েছেন। যারা বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পনিতে কর্মরত। এটা প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু ভারত-চীনের সম্পর্ক বৈরি-এটা নতুন নয়।
বাংলাদেশকে নিয়ে আনন্দবাজার যে ন্যাক্কারজনক শব্দ ব্যবহার করেছে সেটা এখানে লিখাটাও সমীচীন হবে না। আবার সেই দোষটা চাপানো হয়েছে ঢাকার প্রতিনিধিদের ওপর। কিন্তু ঢাকার প্রতিনিধিরা এটা প্রতিবাদ করায় হয়তো নিজেরা চাপে পড়ে ভুল স্বীকার করেছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তারা নি:শর্ত ক্ষমা চেয়েছে। ভুল স্বীকারের ভাষাটা সত্যিই চমকপ্রদ। পত্রিকার সম্পাদক যত বড় মাপের সাংবাদিক হন না কেন- সে পত্রিকা যদি পাঠক না কেনে তাহলে সেটার কোন মূল্য থাকে না। পাঠকের মতো করে উপস্থাপন করতে না পারলে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নেয়। যার ফলে পত্রিকার রমরমা অবস্থা খুবই ক্ষিপ্রভাবেই নিম্নগামী হয়। এজন্যই হয়তো আনন্দবাজার-এর সম্পাদক পাঠক মহলকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বলেছেন- তাদের সেই শব্দ ব্যবহারের ফলে অনেক পাঠক আহত হয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশীরা মর্মাহত কিনা-বা কূটনৈতিকভাবে সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য। এমনকি সংবাদমাধ্যম হিসেবে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করাটা ঠিক হয়েছে কিনা- সে বিষয়ে তারা কিছুই বলেনি। এটা সত্যিই বিস্ময়কর! সম্পাদক এখানে দুটো কাজ করেছেন সুক্ষ্মভাবে। প্রথমটা ভুল স্বীকার, আর দ্বিতীয়টা হলো- পাঠককে ধরে রাখার চেষ্টা। আহা! পলিসি। সত্যিই চমৎকার।
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই বলা প্রয়োজন, তা হলো- বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে অনেকটাই এগিয়ে। দারিদ্র বিমোচনেও এগিয়ে। আমাদের অর্থনীতিও দ্রুত এগুচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখেন বার বার। এটাই হয়তো কারো কারো গাত্র দাহের কারণ। কিন্তু আমরা সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাতেই বলতে চাই --
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আঁলো।
তবুও বলি-চিরস্থায়ী হোক ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক। উন্নতি করুন উভয় দেশই। একে অপরের বন্ধু হোক অকৃত্রিম।
এনএস/