ঢাকা, শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১ ১৪৩১

বিনোদনের বদলে যাওয়া মাধ্যম ‘ওয়েব সিরিজ’ বিতর্ক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:০৫ পিএম, ২৪ জুন ২০২০ বুধবার | আপডেট: ০৩:১২ পিএম, ২৪ জুন ২০২০ বুধবার

সময়ের পথে হেঁটে প্রযুক্তির কাঁধে ভর করে মাধ্যম বদলের হাওয়া লেগেছে শোবিজ অঙ্গনে। নির্মাণ ও প্রদর্শনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি; গল্প, গান, অ্যাকশন, লোকেশনে বৈচিত্র্য- সব মিলিয়ে দেশে বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ওয়েব সিরিজ। কিন্তু এই ওয়েব সিরিজ আসলে কী? কী আছে এই ওয়েব সিরিজে? কেনো এই সিরিজ নিয়ে এতো বিতর্ক? সেই সব বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদন-

ওয়েব সিরিজ কী?

বিনোদন ভুবনে বর্তমান সময়ে ওয়েব সিরিজ অতি পরিচিত একটি নাম। যদিও অনেকের কাছে এখনও ‘ওয়েব সিরিজ’ শব্দটা অপরিচিত। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কাছে। তবে যারা প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তারাই কেবল এর সঙ্গে বেশি পরিচিত আছেন। 

চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করে ইন্টারনেটের বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইটে প্রকাশ করা হয় বলে এর নামকরণ হয়েছে ওয়েব সিরিজ। সহজ ভাষায়, শুধু অনলাইন বা অনলাইন টিভির জন্য তৈরি ও প্রকাশিত ধারাবাহিকের (ধারাবাহিক ভিডিও) নাম ওয়েব সিরিজ। তবে এই সব ওয়েব সিরিজ দেখতে হয় অর্থ খরচ করে।

কী আছে এই ওয়েব সিরিজে?

আসলে কথাটা হবে- কী নেই এখানে? শিশুতোষ অনুষ্ঠান, কার্টুনসহ বিভিন্ন সিরিজ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নতুন চলচ্চিত্র- সবই রয়েছে এই ভাণ্ডারে। ফলে এই সাইটগুলো এখন দখল করে নিয়েছে ছেলে-বুড়ো সবার মন। হুমড়ি খেয়ে যেভাবে এক সময় টিভি দেখত মানুষ, এখন দেখে ইউটিউব বা ওয়েব সিরিজ। 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি মাসে ৮০ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ঢুঁ দেয়। গড়ে প্রতি মাসে শুধু ইউটিউবেই সময় কাটায় তিন বিলিয়ন ঘণ্টারও বেশি!

শুরুটা যেখানে
হলিউডে নব্বইয়ের দশকে এর প্রচলন শুরু হলেও, একুশ শতকে ইন্টারনেটের ব্যাপকতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ওয়েব সিরিজ। আমেরিকান লেখক ট্রেসি রিড লিখিত ‘কোয়ান্টামলিঙ্ক সিরিয়াল’ (১৯৮৮-৯৯) দিয়ে এর যাত্রা। বিশ শতকের শেষ দিকে স্কট জাকারিনের সৃষ্টি ‘দ্য স্পট’ দিয়ে জনপ্রিয়তার সিঁড়িতে ওয়েব সিরিজের উত্থান। একুশ শতকে এর বিশ্বভ্রমণ, বিনোদনের প্রভাবশালী বিকল্প মাধ্যম হয়ে ওঠা। পার্শ্ববর্তী ভারতেও এর যাত্রা শুরু অনেক আগে।

ভারতে ওয়েব সিরিজ
ভারতে এরই মধ্যে ওয়েব সিরিজ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাশাপাশি অশ্লীলতার কারণে বিতর্কিতও হচ্ছে এই মাধ্যমটি। ইউটিউবে এমন অনেক চ্যানেল রয়েছে যাদের কাজই হচ্ছে বয়োজৈষ্ঠ্যদের দেখার উপযোগী ওয়েব সিরিজ তৈরি ও প্রচার করা। এতে চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার বাড়ে দ্রুত। গল্পের মাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা দিতে গিয়ে নেতিবাচক বিষয়গুলোকেই গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরা হচ্ছে ওয়েব সিরিজগুলোতে।  

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজ
বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা ২০১৭ সালে। ওই বছর ঈদুল ফিতরে টিভির পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে একাধিক ধারাবাহিক নাটক প্রকাশ পায়। এর মধ্যে সিএমভির ইউটিউব চ্যানেলে ৭ পর্বের ‘আমি ক্রিকেটার হতে চাই’ ও ‘অ্যাডমিশন টেস্ট’, ‘এল আমোর টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে ‘টেস্টিং সল্ট’, বাংলা ঢোলের উদ্যোগে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম বাংলাফ্লিক্সে প্রচার পায় বিশেষ নাটক ‘উপহার’। বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা মূলত তখন। এরপর ঈদুল ফিতরের ধারাবাহিকতায় ঈদুল আজহায়ও প্রকাশ পায় একাধিক নাটক।

বিতর্কটা কোথায়?
আলোচনা বা প্রশংসা নয়, সমালোচনা ও বিতর্ক দিয়েই বাংলাদেশে ‘ওয়েব সিরিজ’-এর যাত্রা। ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক দিয়েই ওয়েব সিরিজের দৃষ্টি আকর্ষণ। এমনকি কপালে জনপ্রিয়তার তকমা সাঁটার আগেই সেঁটে গেছে যৌনতা, অশ্লীলতার তকমা।

ওয়েব সিরিজগুলোয় অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক যৌনতা, অশালীন সংলাপ ও অঙ্গভঙ্গি, মাদক গ্রহণের দৃশ্যবলীর কারণেই মূলত এ সমালোচনা। বিষয়বস্তু বা শিল্পগুণের বদলে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ দৃশ্যের বন্দুকে সস্তা ও দ্রুত জনপ্রিয়তা বা বিপুল ভিউয়ার বা সাবস্ক্রাইবার শিকারের চেষ্টা, নাটকগুলোয় খুব দৃষ্টিকটুভাবে পরিলক্ষিত হয়। আর সেই চেষ্টায় এখন যোগ হয়েছে পর্নোগ্রাফি।

বর্তমান পরিস্থিতি
‘শয্যাদৃশ্যের প্রয়োজনে কাহিনী, নাকি কাহিনীর প্রয়োজনে শয্যাদৃশ্য- এ এখন বিরাট ধাঁধা।’ হালের কিছু ওয়েব সিরিজকে ঘিরে স্যোশাল মিডিয়ায় এখন অসংখ্য মন্তব্যের ঝড়। বাংলাদেশের দর্শক কখনও কল্পনা করেননি, নাটক দেখতে গিয়ে তাদের পর্নো সদৃশ কিছু দেখতে হবে। কখনও ভাবেননি, শালীন-কুলীন প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন নগ্ন ও অশালীনরূপে তাদের সামনে হাজির হবেন।

সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘বুমেরাং’-এর ‘তোমার ঘরে বাস করে কয়জনা’ পর্বটি শুরুই হয় অভিনেতা আদনান ফারুক হিল্লোল ও অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষার দীর্ঘ বেডসিন দিয়ে। দেশীয় নাটকে এমন পর্নো দৃশ্যের সংযোজন সম্ভবত এই-ই প্রথম। ইন্টারনেটে এমন ভিডিও অহরহ। কিন্তু এমন ভিডিওতে দেশের প্রথম সারির নির্মাতা বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাবলীল অংশগ্রহণ অকল্পনীয় ও অবিশ্বাস্য।

পুরো নাটকে প্রিয় পাত্র-পাত্রীদের এমন খোলামেলা ও রগরগে উপস্থিতি- সত্যিই প্রথম দেখাতে চোখ কপালে ওঠার মতো। 

অন্যদিকে ‘বুমেরাং’-এর ‘ঝড়ো হাওয়া লেগে তার শিখা নিভে যাবে’ পর্বটি আরও বেশি রগরগে ও যৌন উত্তেজক। এমন নাটকে পরিচিত মুখ মৌটুসী বিশ্বাস, ইমি, শ্যামল মাওলা ও তানভীরদের দেখে সত্যি লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা হয়। আর ‘সদরঘাটের টাইগার’কে নাটক না বলে ‘গালি ব্যাংক’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন ‘অশ্লীল গালিময়’ নাটক দেশে, আর হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। 

অন্যদিকে ‘১৪ আগস্ট’ সিরিজটিতে যৌনতা, সহিংসতা, মাদক, অশ্লীল সংলাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বখে যাওয়া ঐশীর কাহিনী।

মতপার্থক্য
অনেকে এটাকে ভিন্ন ভাবে ব্যখা দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য- প্রথমত, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে সাবস্ক্রিপশন বেইজড একটি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম যেটা আপনাকে প্রথমে ডাউনলোড করতে হবে, তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করে সাবস্ক্রাইব করতে হবে এবং এরপর আপনি স্বেচ্ছায় ঠিক করতে পারবেন আপনি ঠিক কোন কন্টেন্ট দেখতে চান। এটা টেলিভিশনের মতো গণমাধ্যম না যে সবাই মিলে একসঙ্গে দেখতে গিয়ে বিব্রত হতে হবে। আপনি সাবালক এবং উপার্জনক্ষম হলে তবেই স্বেচ্ছায় এই প্ল্যাটফর্ম কিনে দেখতে পারবেন যেটা কোনো নাবালক বা উপার্জন অক্ষম কারো পক্ষে সম্ভব না। একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার কন্টেন্ট থাকে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী। একজন নির্মাতা তার সৃষ্টিশীল তাড়না এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তার মতো করে একটা গল্প বলেন। তার গল্প এবং বক্তব্যকে দর্শকের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্যে তিনি গল্প বলার বা চিত্রকল্প তৈরি করার সব ধরনের টুল ব্যবহার করেন। এটা পুরোপুরি নির্মাতার স্বাধীনতা। তিনি সফল হলেন কি ব্যর্থ সেটা সময় বলে দিবে। গল্পের প্রয়োজনে যেকোনো চলচ্চিত্রে বা ওটিটি কন্টেন্টে রক্তপাত, যৌনদৃশ্য, চুমু তিনি আনতেই পারেন। পুরো গল্পের কন্টেক্সটে একে মূল্যায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ওই অংশটুকু কেটে প্রচার করে পুরো ওয়েব সিরিজ বা গল্পকে খারিজ করে দেওয়া আর নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অন্যায়। আবার সব গল্পে যে এইসব দৃশ্য থাকবে তা নয়। সেটাও নির্মাতার স্বাধীনতা। পৃথিবীতে নানান ধরনের গল্প থাকবে। একেক গল্প বলার ঢং একেক রকম হবে। সব গল্প বলার ঢং যদি এক রকম হয়ে যায় তাহলে দর্শকও সেই সব গল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। 

দেশে কারা সংযুক্ত আছেন
তারকাদের মধ্যে চিত্রনায়িকা পপি, আঁচল, অপু বিশ্বাস। নাট্যঅভিনেতা তারিক আনাম খান, অপূর্ব, তাহসান, আফরান নিশো, মিথিলা, মেহজাবিন, মুমতাহিনা টয়া, জোভান, তৌসিফ মাহবুব, অর্চিতা স্পর্শিয়া, সাফা কবিরসহ অনেকেই এখন যুক্ত হয়েছেন এই মাধ্যমে।

বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করছেন বায়োস্কোপ, বাংলাফ্লিক্স, আইফ্লিক্স, সিএমভি, বাংলা ঢোল, ধ্রুব টিভি প্রভৃতি চ্যানেল।

নির্মাতাদের কাতারেও লাইটা দীর্ঘ হতে শুরু করেছে।

মতামত

এ বিষয়ে অভিনেতা আফজাল হোসেনের বক্তব্য, ‘ওয়েব দুনিয়ায় আমরা প্রবেশ করেছি। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। কিন্তু ওয়েবের সমুদ্রে কী দেখব আর কী দেখব না, তা কিন্তু আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এখানে যেমন ভালো কিছু আছে, তেমনই আছে খারাপ কিছু।’ 

বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী মামুনুর রশীদ বলছেন, ‘এখন ওয়েব সিরিজে যা দেখানো হচ্ছে দেশ এটা দেখার জন্য প্রস্তুত না। শ্লীলতা বা অশ্লীলতাই একটা আপত্তির জায়গা। দুর্নীতি বা এ ধরনের অনাচার নিয়ে কিন্তু এসব সিরিজ হয়না, হয় সেক্স আর ভায়োলেন্স নিয়ে।’

তিনি বলেন, ‘এখানে যে ওয়েব সিরিজ হয়েছে সেখানে এমনও হয়েছে যে ভাষার চরম বিকৃতি ঘটানো হয়েছে কিন্তু টেলিভিশন কি এভাবে আমরা শূন্যে ছেড়ে দিবো?’

তবে তার এ বক্তব্যের সাথে একমত নন তরুণ নির্মাতা ও লেখক আশফাক নিপুণ। তিনি বলছেন, ‘ওয়েব সিরিজ টেলিভিশনের মতো কোনো মাধ্যম না। ওয়েব সিরিজ দেখার জন্য আপনাকে কয়েক ধাপ পেরিয়ে সেটি কিনতে হবে। এটি একটি সেন্সর প্রক্রিয়া। অর্থাৎ আপনি কোনটি দেখবেন সেটি আপনিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। ধরুন কেউ যদি মনে করে যে আমি হরর মুভি দেখবোনা তাহলে তিনি সেই কনটেন্ট দেখবেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি তো দাবি করতে পারেননা যে হরর মুভি সরিয়ে দিন।’

সমাধান কী?
টিভিতে প্রচারিত নাটকগুলো নির্মাতা সরাসরি দেখাতে পারেন না। এজন্য সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের প্রিভিউ কমিটি বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগে। সিনেমার ক্ষেত্রেও একইভাবে আছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র। কিন্তু শুধু অনলাইনে গান বা ভিডিও প্রকাশে এ ধরনের অনুমোদন বা সেন্সরশিপের ব্যবস্থা নেই। নির্মাতারা এ ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ স্বাধীন। আর স্বাধীনতা যেখানে অবারিত, অপব্যবহার সেখানে অবধারিত। তাই ওয়েব সিরিজের অরাজকতা বা অশ্লীলতা ঠেকাতে চাইলে, এখানেও এক ধরনের সেন্সরশিপ সিস্টেম রাখা দরকার।

এজন্য সংস্কৃতি বা তথ্য মন্ত্রণালয়ে ‘অনলাইন কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ কমিটি’ নামে কমিটি চালু করা যেতে পারে। অনলাইনে কোনো ভিডিও ছাড়ার আগে এ কমিটিতে জমা দিতে হবে। কমিটি সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে অশ্লীলতা, মানহানি, ধর্ম অবমাননা, রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কন্টেন্টের বিষয়টা খতিয়ে দেখবে। তাদের অনাপত্তি পেলেই কেবল ভিডিওটি অনলাইনে ছাড়া যাবে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বিটিআরসিতেও এ ধরনের একটা সেল থাকতে পারে।

এসএ/