ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

আমার ছোট ভাই বুলবুলের মৃত্যু এবং কিছু কথা

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ১২:২০ পিএম, ২৫ জুন ২০২০ বৃহস্পতিবার

রুস্তম আল বুলবুল

রুস্তম আল বুলবুল

বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ অনেক ভারি। বড় ভাইয়ের কাঁধে অকালে হারানো ছোটভাইয়ের লাশ কতোটা ভারি, যার এই দুর্ভাগ্য হয়েছে সেই জানে কতোটা পাহাড়ের সমান। সেই ভারি ছোটভাইয়ের কাঁধে প্রতিদিনের জীবনে বেঁধে থাকা ৪৭ বছর বয়সী বড় ভাইয়ের লাশ। সেই বেদনা ও আর্তনাদ কী ভয়াবহ, বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের থেকেও তা গভীর। আমার ছোট ভাই বুলবুল-রুস্তম আল বুলবুল ঠিক এভাবেই বাবা-বড় ভাই আর ছোটভাইয়ের কাঁধে চড়ে শেষ ঘুমের ঠিকানায় চলে গেছে গত ৩ জুন। 

বুলবুল আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। অংকের হিসাবে তার বয়স এখন ৪৭ বছর। আমিই ওর নাম বুলবুল রেখেছিলাম আমার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে। আমি এমনি এক হতভাগা, নিজের ছোট ভাইকে নিয়ে আমাকেই আজ লিখতে হচ্ছে, যে লেখা বুকভাঙা বেদনার। 

নিজের কাঁধে করে বুলবুলকে কবরস্থানে নিয়ে যাবার যে ভার, আমার কাছে এই লেখার প্রতিটি শব্দ ঠিক সেরকমই ভারি। আমার বুক ভেঙে এখানে আছড়ে পড়ছে। জীবনে লেখক হতে চেয়েছিলাম, যেকারণে বাংলা পড়েছিলাম। যদি জানতাম আমার ভাইকে নিয়েই এরকম বুকভাঙা কষ্টের কান্নার বেদনাকাব্য লিখতে হবে আমাকে, তাহলে আমি কোনদিন লেখক হতে চাইতাম না। লেখক হতামও না। অনেকবার ভেবেছি লিখবো না এই বেদনার কথা, কষ্টের কথা। আবার ভেবেছি, কেন লিখবো না, স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হয়ে কেন এমন অবহেলায় তার মৃত্যু হলো! সে কথা জানানোও তো আমার দায়িত্ব। 

এরপর অনেকবার ভেবেছি বুলবুলকে নিয়ে লিখবো, বিশেষ করে কিভাবে তার মৃত্যু হলো। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকায় তা লেখার শক্তি আমার হয়ে ওঠেনি। আবার ভেবেছি আমার ভাইটা তো এমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন, তাকে নিয়ে লিখতে হবে। আবার এও ভেবেছি, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও তো আমার ভাইটার এদেশে চিকিৎসা পাবার অধিকার ছিল। করোনা রোগী না হওয়া সত্ত্বেও করোনা রোগী ধারণা করে তাকে চিকিৎসাবঞ্চিত করে, মৃত্যুকূপের দিকে এগিয়ে দেয়ার অধিকার তো কারো ছিল না। 

দেশের একজন নাগরিক হিসেবে চিকিৎসা পাবার অধিকার তো তার ছিল। নিজের ব্যক্তিগত বেদনার কথা অন্যকে জানিয়ে, অন্যের মন খারাপ করে দেয়ারইবা কি দরকার! কতরকম ভাবনা আমার ভেতর জলের স্রোতের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। কি লিখবো, কিভাবে লিখবো, নিজের ভেতরই গুছিয়ে উঠতে পারছি না। আমি এক অসীম বেদনার ভেতর ডুবে আছি। 

ছত্রিশ বছর আগে আমার মা এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। বুলবুল তখন এগার বছরের। মায়ের মৃত্যুর সময় যে বুলবুল দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে বলেছিল, মেজো ভাই, মা কই! সে প্রশ্নের উত্তর সেদিন ওকে আমি দিতে পারিনি। আজ আমার সেই ভাইটা চলে গেছে, তার ছেলেমেয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে, মেজো আব্বা, আব্বা কেন চলে গেলো?এর উত্তরও আমি দিতে পারছি না। দুটো উত্তরই আমার কাছে পাহাড়ের মতো ভারি হয়ে গেছে। 

ছত্রিশ বছর আগে আমার মা চিকিৎসা না পেয়ে মৃতুবরণ করেছিলেন। তখন কুষ্টিয়া থেকে বেশ দূরে নদীপার প্রত্যন্ত ‘কয়া’ নামের এক গ্রামে সাধারণ এক মায়ের সন্তান প্রসবকালে ডাক্তার পাওয়া কঠিনের থেকেও কঠিন ছিল। সেই মধ্যরাতে গ্রামীণ কোন ডাক্তারও পাইনি। সন্ধ্যায় মায়ের সাথে হাসিখুশি করে কয়ার বাজারে গিয়েছি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, ফিরে এসে মায়ের সাথে আমার আর দেখা হলো না, যখন দেখা হলো মা তখন নিরব, নিথর প্রাণহীন। 

আমাদের সেই যে বুক ভাঙলো, পাঁজর ভাঙলো, স্বপ্ন ভাঙলো, সেই বেদনা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। গ্রামীণ এক কৃষক পরিবারে মায়ের চিকিৎসাবিহীন এরকম মৃত্যু অনেকের কাছেই হয়তো স্বাভাবিক মনে হবে সময়কাল বিবেচনায়। কিন্তু বুলবুলের মৃত্যুকে আমি কী বলবো কিভাবে নিজের কাছে নিজের শান্তনা নেবো! নিজের ভেতর বেদনায় প্রমত্ত ঢেউ আমাকে আছড়ে ফেলছে, তার বাচ্চাদের প্রশ্ন।

বুলবুল তো গ্রামে থাকতো না। দেশের রাজধানী ঢাকাতেই থাকতো। যেখানে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসা। কারণ, এখানে বড় বড় হাসপাতাল আছে। অন্তত ভালো চিকিৎসাটা পাওয়া যায়। মারা গেলেও নিজের কাছে পরিবারের কাছে একটা শান্তনা থাকে চিকিৎসা তো করাতে পেরেছি। কিন্তু এই শান্তনার জায়গাটুকুও যদি না থাকে, তাহলে নিজের ভেতর সারাজীবন এই বেদনা আর ক্ষত নিষ্ঠুর নির্মম বিষাক্ত দংশন করবে, যার বিষক্রিয়ায় সারাজীবন ছটফট করে মরতে হবে। নিজেকে ও পরিবারের আপনজনদেরও। আমাদের অবস্থা এখন তাই।

৩১ মে। আমার মেয়ে কাব্যর এসএসসি রেজাল্টের দিন ছিল। আমার জন্মদিন ছিল। রেজাল্ট হলো। আমি ফেসবুকে বাবা-মেয়ের ছবিসহ পোস্ট দিলাম ‘বাবার জন্মদিনে মেয়ের উপহার গোল্ডেন প্লাস’। আমার অনুজ ভূমি গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিলন হাসান ফোন দিয়ে অভিনন্দিত করলো কাব্যকে, আমাদেরও। সেদিনই প্রথম আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভূমি গ্রুপের অফিস খুলেছে। মিটিং চলছে। মিটিংয়ের ভেতর থেকেই ওর অভিনন্দনের ফোন। 

বুলবুলও তখন মিটিংয়ে। মিটিংয়ে সবাইকে জানানো হয় পরিবারের এই সুখবর। সন্ধ্যার পরে ওরা আসবে আমার বাসায়। খুব বড় একটা আনন্দের দিন আমাদের। আমরা কোন বিখ্যাত পরিবারের সন্তান নই। গ্রামের সাধারণ পরিবারে জন্মেছি। বাপ-দাদার নাম আছে। কিন্তু বিখ্যাত বলতে যা বোঝায় ওসব কিছু নয়। সেরকম এক সাধারণ পরিবারের উত্তরসূরি ভিকারুন নূন নিসা স্কুলে পড়ে এটাই যেন স্বর্গকে হাতের মুঠোয় পাওয়া। সবারই প্রত্যাশিত কাব্য গোল্ডেন প্লাস পাবে, পেলোও তাই। উৎসবে আমরা মেতে উঠবো এটাই স্বাভাবিক। 

কিন্তু অদৃষ্ট বলে একটা ব্যাপার আছে মানি না মানি তার ধার ধারে না। বেদনার ভয়াবহ এক কালোমেঘ যে তখন আমাদের জীবনে অপেক্ষা করছিল, আমরা ভুল করেও তা একটুও বুঝতে পারিনি। বিকেল ৫টা ৭ মিনিটে বুলবুলের ফোন, মেজো ভাই, ‘কাব্যমুনি তো গোল্ডেন প্লাস পাইছে, ওর জন্য আমি কি কিনে আনবো? আমি তো ছোট মানুষ!’ আমি তখন বাজারে ওদের জন্য বাজার করছি। বুলবুল মিলন ওরা রাতে খাবে। আমি ব্যস্ততার সাথে বললাম, ‘তোর কিচ্ছু কিনতে হবে না। শুধু দোয়া করিস। সন্ধ্যায় বাসায় চলে আয়।’ বুলবুল বললো, না, আপনার সাথে কথা বলে হবে না। মামণির সাথে কথা বলি (আমার সব ভাইবোন আমার স্ত্রীকে মামণি ডাকে। কারণ তিনি মায়ের মতোই স্নেহ আদর দিয়ে তাদের বড় করেছেন)। বলেই ফোনটা রেখে দেই। পাঁচটা দশে আবার ফোন করেছিল, আমি তা টের পাইনি। মোবাইলটা সাইলেন্ট করা অবস্থায় পকেটে ছিল। আমি তখন বুঝিনি, আমার ভাইটার সাথে আমার এ জন্মের মতো শেষ কথা হয়ে গেছে। আর কখনো বুলবুল শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে ‘মেজো ভাই’ বলে ডাক দেবে না। 

সোয়া ছ’টার দিকে আমার সবচেয়ে ছোট ভাই মিলন হাসান, আমাকে ফোন করলো, বললো, মেজো ভাই, সেজো ভাই ব্রেইন স্ট্রোক করে পড়ে মাথা ফেটে গেছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সে আগারগাঁও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি বাসা থেকে তাড়াতাড়ি নামেন। আমি গাড়ি বের করছি। মিলন অফিস থেকে একটু আগেই বাসায় এসেছে। বুলবুল তখনো অফিসে। নিজেদের অফিস। পিয়ন আছে সব আছে। পিয়নকে না বলে নিজেই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে খেতে বসবে, প্লাস্টিকের টুলের উপর বসতে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। বসা আর হয় না। পড়ার সাথে সাথে জ্ঞান হারায়। শেষ পর্যন্ত জ্ঞান আর ফেরেনি। খাবার অমনি পড়ে থাকে, আমার ভাই চিরতরে অচেতন হয়ে যায়।

আমরা দুই ভাই মিলন আর আমি যখন নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে পৌঁছলাম, তখন আমাদের বুলবুল স্ট্রেচারে। আমি ডাকলাম, বুলবুল, কথা বল। আমি মেজো ভাই। আমি বুলবুলের মাথায় হাত দিই। মুখটা নাড়তে থাকি। মিলন কয়েকবার ডাক দিলো, সেজো ভাই, কথা বলেন। যে বুলবুল আমার ডাক শোনামাত্রই পরম শ্রদ্ধায় বলে উঠতো, ‘মেজো ভাই’। এই প্রথম আমার ডাকের কোন উত্তর দিলো না। যে মিলনকে অন্ধের মতো ভালোবাসে, সন্তানের মতো করে ভালোবাসে সেই মিলনের ডাকও ব্যর্থ হয়ে ভেসে গেলো বাতাসে। 

ডাক্তাররা দ্রুত নানা পরীক্ষা করলেন, তারা রিপোর্ট দেখে আত্কে উঠলেন। বললেন, ‘আপনারাও উনার থেকে দূরে সরে যান। উনি করোনা আক্রান্ত।’ আমি বললাম, ও তো গতকাল বাড়ি থেকে এসেছে। আমাদের গ্রামে কেউ করোনা আক্রান্ত নেই। ও সবসময় বাড়িতেই ছিল। ও করোনা আক্রান্ত নয়। আমি চ্যালেঞ্জ করলাম। আমার ভাগ্নে রাশেদ তার সেজো মামা বুলবুলকে নিয়ে তখন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অফিসেরও কয়েকজন আছে। 

ডাক্তাররা বললেন, উনাকে এখান থেকে নিয়ে যান। উনার আইসিইউ লাগবে। আমি ও মিলন নানা হাসপাতালে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমাদের বন্ধু ও বড়ভাইতুল্য ডাক্তাররা ঢাকা শহরের প্রায় সব হাসপাতালে আইসিইউ-এর জন্য চেষ্টা করলেন। আমার সাংবাদিক কয়েকজন বন্ধুও চেষ্টা করলেন। কোন কোন হাসপাতাল থেকে বলা হলো, টাকা-পয়সার সামর্থ্য কেমন আছে? 

আমাদের পক্ষ থেকে বলা হলো, সেসবের সমস্যা নেই। আইসিইউ পেতে হবে আমাদের। মনে হলো আইসিইউ পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু না, আইসিইউ তখন আসমানের তারা জ্বলছে দূরে, ধরা যায় না। আমার ভাইটার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকেও দ্রুত বিদায় করে দিতে চাচ্ছেন ডাক্তাররা। আমরা নিউরো সায়েন্সেই ভর্তি করানোর জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম। তারা ভর্তি করলেন না। ধরেই নিলাম, আমার ভাই করোনা আক্রান্ত, তাই বলে কি সে চিকিৎসা পাবে না? ডাক্তাররা বললেন, ‘রাতের ভেতরই আপনার ভাই মারা যাবে। রাত পার হবে বলে মনে হয় না।’

এ কথা শোনার পর আমরা দুই ভাই এবং আমার ভাগ্নে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমরা যে কতো অসহায় তখনি বুঝলাম। ডাক্তররা বললেন, ‘এভাবে পথে পড়ে থেকে মারা যাবার থেকে অন্তত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। ওরা ভর্তি নেবে। তবুও তো মনের কাছে একটা শান্তনা পাবেন, চিকিৎসা করাতে পেরেছেন।’

যে বাসায় আনন্দ উৎসব হওয়ার কথা, যে উৎসবে ও থাকবে, ভাতিজিকে আশীর্বাদ করবে। সে এখন চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে। এ কথা আমি কিভাবে বাসায় বলি! বৃদ্ধ বাবাকে বলি! অন্য ভাইদের বলি! বোনদের বলি! আমার চারদিক ভয়ার্ত অন্ধকার হয়ে আসে। মিলন কাঁদছে আর ফোনে কাউকে মিনতি করছে, ‘বড় ভাই, একটা আইসিইউয়ের ব্যবস্থা করে আমার ভাইটাকে বাঁচান।’

ডাক্তারদেও পরামর্শে বুলবুলকে অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলো। সেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া এতো দীর্ঘ আমার ভাইটাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে না। স্ট্রেচে পড়ে আছে। শ্বাসকষ্টে নদীর প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো তার পেট ওঠানামা করছে। বুকটা যেন ভেঙে পড়ছে। ডাক্তারদের অক্সিজেন দেয়ার জন্য হাতেপায়ে ধরেও কোন কাজ হয় না। 

তারা বললেন, করোনা রোগী। তারা ভর্তি করলেন করোনা ইউনিটে। অক্সিজেন দিলেন। মধ্যরাতে দেখা গেলো, তার মুখে অক্সিজেনের মাস্ক ঠিকই লাগানো আছে। কিন্তু অক্সিজেন চলছে না। ডাক্তারদের খুঁজে পাওয়া যায় না। পেলেও আসে না। মৃত্যুযন্ত্রণায় তখন সে ভুগছে। ডাক্তারদের বারবার বলা হয়, অনুরোধ করা হয়, ‘উনি তো মারা যাচ্ছেন, আমরা বুঝতে পারছি। অক্সিজেনটা দেন, একটু শান্তিতে মরুক।’ কে শোনে কার কথা। এভাবে পার হয় দুঃসহ রাত।

সকাল ১০টায় শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে মিলনকে ফোন করে জানানো হয়, ‘মিলন, তুমি তোমার ভাইকে তাড়াতাড়ি আমাদের এখানে নিয়ে আসো। আমরা একটা আইসিইউয়ের ব্যবস্থা করেছি।’ এখানে বলা দরকার, এই হাসপাতালের বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সাথে মিলনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, পরিবারের আপনজনের মতো। তারাও বিভিন্ন হাসপাতালে আইসইউ পেতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাননি। শেষে নিজেদের হাসপাতালে একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন।

ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাতে যতো নিয়মকানুন সময়ক্ষেপণ ছাড় পেতেও একই অবস্থা। প্রায় ঘণ্টাখানেক পার হয়ে যায় বুলবুলকে বের করে আনতে। বুলবুল তখনো যে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে আছে, সেটাই সবার কাছে বড় বিস্ময়। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তাররা কেন তার অক্সিজেন মধ্যরাতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ প্রশ্ন আমাদের সারাজীবনের। 

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে বুলবুলকে আনার সাথে সাথে সেখানকার ডাক্তাররা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে বুলবুলকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। আমি নিজেও ডাক্তার হলে আমার ভাইয়ের জন্য হয়তো ঠিক এই চেষ্টাটাই করতাম। বুলবুলের করোনা পরীক্ষা করা হলো, রিপোর্ট নেগেটিভ এলো। কিন্তু করোনা ধারণা করে আমার ভাইকে প্রাথমিক চিকিৎসাটাই কেউ করলো না।

বাংলাদেশ স্পেশালঅইজড হাসপাতালে আনার আগে ১৬/১৭ ঘণ্টা চিকিৎসার নামে চিকিৎসাহীন হয়ে অবহেলায় সে পড়ে ছিল, তার মৃত্যুটা তো তখনি হয়ে গেছে, যেটুকু ছিল তা শুধুই সময়ের অপেক্ষা। আইসিইউ থেকে বুলবুলের অক্সিজেন হার্টবিট একটু বাড়ছিল, কিন্তু এবার হার্টঅ্যাটাক হলো, কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলো লাইফ সাপোর্টে। অনেকেই শান্তনা দিলেন লাইফ সাপোর্ট থেকেও অনেকেই ফেরেন। কিন্তু আমার ভাইটার আর ফেরা হলো না। 

৩ জুন সকাল ১১টায় আমরা তাকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেললাম। প্রথম থেকেই যদি আমার ভাইটাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটা দিতে পারতাম, তাহলে হয়তো তাকে অকালে আমাদের হারাতে হতো না।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স সবাই আমার ভাইটির জন্য যে আন্তরিক প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, আমরা চিরকাল তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। এই ভেবে শান্তনা নেবো, শেষমুহূর্তে হলেও তো তোমাকে এই দেশে এখন নক্ষত্র হাতে পাবার মতো আইসিইউ দিতে পেরেছিলাম, এ ছাড়া আর কোন শান্তনা নেই আমাদের। আমাদের ক্ষমা করে দিও। ৬/১৭ ঘণ্টা তোমাকে চিকিৎসাহীনভাবে থাকতে হয়েছিল রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। ভাইটি আমার, আমরা কত অসহায় তোমার মৃত্যুতে বুঝেছি, জেনেছি। আমাদের এই অসহায়ত্বকে তুমি ক্ষমা করে দিও।

বুলবুল, ভাই আমার, যেখানে থেকো ভালো থেকো। আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ভাববো, আমার ভাইটি ঠিক দূরের অই নক্ষত্র, আমি তার আলোটা বুকের ভেতর ধরে রাখি। 

লেখক: কবি, কথা শিল্পী ও প্রাবন্ধিক। চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।