স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি বলেই এ বয়সেও ভালো আছি
বাবু সুকুমার চক্রবর্তী
প্রকাশিত : ০৩:১৭ পিএম, ২৭ জুন ২০২০ শনিবার
কিছুদিন আগে আমার জ্বর হলো। ডাক্তার বললেন, এ জ্বর করোনার উপসর্গ নয়। পরবর্তী সময়ে তার কথাই ঠিক হলো। তিন দিন পর জ্বর সেরে গেল। এখন আমি বেশ ভালো আছি। কারণ আমি সব রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি। দিনে অন্তত চার-পাঁচ বার হাত ধুই। ঘরে রান্না করা খাবার ছাড়া বাইরের কিছু খাই না। ঘরের মধ্যে পায়চারি করি, ঘরের কাজগুলো করি। অবশ্য আমি আগে থেকেই এসব ব্যাপারে সচেতন ছিলাম।
আমার শোয়ার ঘরে দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে খোলা জানালা আছে। ফলে ঘরে প্রচুর আলো-বাতাস আসে। সকালবেলা আমার ঘুম ভেঙে যায় যখন রোদ এসে বিছানায় পড়ে। আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে বলেছেন, সকালবেলা কাঁচা হলুদ ও মধু খেতে। আমি প্রতিদিন খালি পেটে দুই স্লাইস কাঁচা হলুদ চিবিয়ে তার সঙ্গে এক চামচ মধু খাই। এরপর পানি পান করি।
গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে আমার দিন শুরু হয়। হাত-মুখ ধুয়ে আমাদের ধর্মগ্রন্থ গীতার একটা অধ্যায় পাঠ করি। মন যদি কখনো বিক্ষিপ্ত হয়, গীতা পাঠ আমার মনকে শান্ত করে, সংহত করে। মনে প্রশান্তি এনে দেয়। আমাদের বাসায় প্রার্থনার জন্যে আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে, সেখানে বসে আমি দমচর্চা ও মেডিটেশন করি।
লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে কোয়ান্টাম হার্ট কেয়ার-এর সমন্বয়ক ডা. মনিরুজ্জামানের টেলিফোন পেলাম। তিনি জানালেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুজী আমাদের কালোজিরা, কাঁচা রসুন ও মধু খেতে বলেছেন। তারপর থেকে এসব আমি নিয়মিত খাচ্ছি। এর সাথে দুটি রুটি, একটি ডিমের সাদা অংশ আর সবজি দিয়ে নাশতা করি। কিছুক্ষণ টিভিতে খবর দেখি। এরপর অল্প সময় ঘরেই হাঁটাহাঁটি করি। আমার বারান্দায় দুরকম নয়নতারা ফুলের গাছ ও দুটো তুলসী গাছ আছে। গাছে পানি দেই, যত্ন করি। প্রতিদিন আমি ওখান থেকে দুটো তুলসী পাতা খাই।
বাসায় আমার একটি ছোট লাইব্রেরি আছে। তাতে বইয়ের সংখ্যা হবে হাজারখানেক। আমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা থেকে বই কিনি এবং আলমারিতে রেখে দেই অবসর সময়ে পড়ব বলে। অফুরন্ত সময়ে পেয়ে এবার অনেকগুলো বই পড়ে ফেললাম।
আমার এক বন্ধু ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি যে সমস্ত তীর্থস্থান ভ্রমণ করেছেন, তার ওপর একটি বই লিখেছেন। সেটিও পড়েছি। ভালো লেগেছে। আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শ্রীকৃষ্ণকে অবতার হিসেবে জানি। বঙ্কিমচন্দ্রের একটি বই পড়ে তাঁর সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানতে পেরেছি। এ-ছাড়াও মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথলকৃত পবিত্র কোরআনের অনুবাদ দ্য মিনিং এন্ড মেসেজ অব হলি কোরআন পড়ি। প্রতিদিনই আমার কোনো না কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়া হয়।
৬০ বছর আগে আমি কর্মজীবন শুরু করি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে। পরবর্তীকালে সোনালি ব্যাংক স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলাম। দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। লেখাপড়ার মধ্যেই আমি জীবন কাটিয়েছি। ক্লাসে ছাত্রদের অমনোযোগী দেখলে বলতাম—দেখ, নবীজীর (স) ওপর যখন কোরআন নাজিল হয়েছে, সেই বাণীর প্রথম শব্দটি হলো ‘ইকরা’ অর্থাৎ ‘পড়ো’। আবার বাইবেলেও একথা বলা আছে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এক ব্যবসায়ী বন্ধুর সাথে আমি ঢাকা থেকে নরসিংদী পালিয়ে গিয়েছিলাম। নরসিংদী থেকে একশ মাইল হেঁটে আমরা টাঙ্গাইল পৌঁছাই পাহাড় ঘেরা একটি পথ দিয়ে। আমার বন্ধুটি ছিল মুসলমান। সে বলল—এখন তোমার নাম সুকুমার নয়, এখন তোমার নাম আবদুল হাই। দাড়ি, গোল টুপি, লম্বা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর একজোড়া চপ্পল পরে নিলাম। টাঙ্গাইলে আমাদের এলাকায় গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা। এক জায়গায় বসে আছি। আমার গায়ের রঙ ফর্সা বলে লোকজন ভাবল, তাদের এলাকায় একজন বিহারি এসেছেন। আমি যে সনাতন হিন্দু ধর্মের, সেটা তারা বুঝতে পারে নি। সে-সময় প্রাণ বাঁচাতে আমি ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু দোয়া ও সূরা মুখস্থ করেছিলাম। এত বছর পর এখন সেটা আমার জ্ঞানের অংশ হয়ে গেছে।
আমার পুরো জীবনটাকে আমি ধর্মীয় কাঠামোতে বেঁধে ফেলেছি। সেইসাথে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে রুটিন মেনে চলি। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ভাতের সাথে শাকসবজি, মাছ ও ডাল রাখছি। কখনো কখনো মুরগির মাংস খাওয়া হয়। আমি চেষ্টা করি দুপুরে আমিষ জাতীয় ডায়েট চার্ট অনুসরণ করতে। তিন বেলায় আমি তিনটি আম খাই। কখনো কখনো আমের টকও খাই।
আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে, খাওয়ার পর পর ঘুমোতে নেই। ১৯৯৫-৯৬ সালে ভারতে ডা. দেবী শেঠীর কাছে যখন চিকিৎসাধীন ছিলাম, তিনি আমাকে একটি কাঠের চেয়ার দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ডিনারের পর কিছুতেই বিছানায় শোবে না। আমি তোমাকে দেখতে না আসা পর্যন্ত প্রতিদিন তুমি এই কাঠের চেয়ারে বসে থাকবে।’ বসে থাকতে থাকতে সেই কাঠের চেয়ারে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। তিনি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘হ্যালো ইয়ং ম্যান! কী, ঘুমিয়ে পড়েছ? হাউ আর ইউ?’ সে-সময় তিনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন, কুশল জিজ্ঞাসায় সবসময় ‘আই অ্যাম ফাইন’ বলবে। তখন আমার বয়স ৬০। ডা. দেবী শেঠীর এ শিক্ষাটি আমি এখনো মেনে চলি। দুপুরবেলা খাওয়ার পর্ব শেষে আমি কিছুক্ষণ পায়চারি করি, কিছুক্ষণ টিভি দেখি। বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার সময় একটি বই সঙ্গে রাখি। বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। একঘণ্টার ভালো ঘুম হয়।
ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আবার বই নিয়ে বসি। বিকেলে চিনি ও দুধ ছাড়া আদা, গোলমরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনিসহ সাত রকমরে মসলা ও সামান্য চা পাতা দিয়ে বাসায় তৈরি হার্বাল চা পান করি। আমি আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আমার জীবনজুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ভাতিজি সায়ন্তী চক্রবর্তী অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বিকেলের সময়টায় তাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা ছড়া আবৃত্তি করি, গান গাই, রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প পড়ি।
সন্ধ্যা ৭টার পর আমি দ্বিতীয় দফায় দমচর্চাসহ মেডিটেশন করি। এখন সবাই বলছে, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নিয়মিত দিনে কয়েক দফা প্রাণায়াম করতে। কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্য হিসেবে অনেক আগে থেকেই আমি দমচর্চা করছি। এখন আরো মনোযোগী হয়েছি।
রাতের খাবার ১০টার মধ্যে সেরে নিই। ঘুম না এলে প্রথমে চোখ বুজে ২০ বার করে ১০ দফা ‘হরি ওম’ জপ করি। এরপর কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের অটোসাজেশন ‘লিভ লং হ্যাপি স্ট্রং গ্রো ইয়ং’ ২০ বার বলি। যদি তা-ও ঘুম না আসে তাহলে ‘সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’ চর্চা করি। এটি বলতে বলতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
আমার এক বন্ধুর অনুপ্রেরণায় মাসখানেক ধরে আমি আত্মজীবনী লিখছি। দিনে দুই-তিন পৃষ্ঠা করে লেখার চেষ্টা করি। আমার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কোয়ান্টাম জীবনদৃষ্টি ও মেডিটেশন। আমার বয়স এ বছর ৮৫ ছাড়িয়ে যাবে। আমি যেন সুস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মময় দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারি—এজন্যে নিজে প্রার্থনা করি এবং সবার দোয়া ও আশীর্বাদ চাই।
লেখক: ব্যাংকিং এন্ড ট্রেনিং কনসালটেন্ট, সোনালি ব্যাংক স্টাফ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ
এমবি//