ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

শিল্প ও শিল্পীদের বাঁচাতে যা জরুরি

কমলিকা চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ০২:৫৭ পিএম, ৩০ জুন ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:১১ পিএম, ৩০ জুন ২০২০ মঙ্গলবার

কমলিকা চক্রবর্তী

কমলিকা চক্রবর্তী

করোনার প্রকোপে স্তব্ধ পুরো বিশ্ব। সবকিছুর মত স্থবির হয়ে আছে বিনোদনের সকল মাধ্যম। সিনেমা, নাটক, খেলা থেকে সংগীত –কোনো পরিসরই মুক্তভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না। 

এপার ওপার দুই বাংলাতেই প্রায় চার মাস ধরে বিরাজ করছে স্থবিরতা। বিশেষ করে এই মহামারির প্রভাবে দিশেহারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। ভালো নেই শিল্পীরা। শিল্পেই যাদের জীবন চলে তারা আজ কর্মহীন। এরইমধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের একটি বিষয় আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। শিল্পীরা এবার নিজেদের প্রাপ্য সম্মানী আদায়ের লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছেন। দিয়েছেন যৌথভাবে বিবৃতি। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। আমি যেহেতু গান ভালোবাসি তাই এ বিষয়ে কিছু মতামত প্রকাশ করতে চাই। যা একান্ত আমার নিজস্ব মতামত। 

করোনায় অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হবে। স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে সংগীতানুষ্ঠানের পেছনে খরচও কমবে। মিউজিকের যে সার্বিকতা শিল্পীরা শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে চান, তা নষ্ট হচ্ছে, হবে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। 

করোনার ক্রান্তিকাল যখন কেটে যাবে, সব কিছু যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করবে তখন কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলে এই কঠিন সময়টাকে অতিক্রম করা যাবে বলে আমি মনে করি। 

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না শিল্পীরা সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম কারিগর। তারা গান-পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরেন এবং মানুষকে বিনোদনের মাধ্যমে সামাজিক উন্নতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। সেই সঙ্গে তারা গানের মধ্য দিয়েই তাদের উর্পাজনের পথ খুঁজে পান। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তারা কর্মহীন-বেকার। বিষয়টি অবশ্যই ভাবনায় নিতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও এই করোনাকালে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই এ বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ শিল্পীরা আমাদের জীবনের প্রতিটা অনুভূতির সঙ্গে মিশে আছেন। আমাদের নিত্য দিনের হাসি-কান্নার অনুভূতির সঙ্গে তারা যুক্ত। শিল্পীর দুর্দিনে পাশে থাকা সবার নৈতিক দায়িত্ব।

শিল্পীরা অসহায় নয়, তারা তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। তবে সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের ৬৪ জেলায় সরকারিভাবে স্থায়ী মঞ্চ করা যেতে পারে। যে মঞ্চে সাংস্কৃতিক চর্চা, অনুষ্ঠান, মেলা, প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। দেশব্যাপী এ সাংস্কৃতিক উৎসবে স্থানীয় শিল্পীদের গান, আবৃত্তি, অভিনয়সহ নানা পরিবেশনা থাকতে পারে। স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং ফুটিয়ে তোলে, এমন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে উৎসবে প্রাধান্য দিয়ে পরিবেশনের চেষ্টা করা হবে। শিল্পীরা এতে অংশ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হবেন। রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীসহ বড় বড় গুণী শিল্পীদের নিয়ে তিন থেকে সাতদিনব্যাপী জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠান করা যায়। এ ছাড়াও আউল বাউল, শিল্পীদের নিয়মিত ভাতার আওতায় আনা যায়। তখন সরকার বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণ করাতে পারে।

দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চা প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের ৬৪টি জেলায় প্রতি বছর ৩ থেকে ৭ দিন এ কাজটি করা সম্ভব। আর এসব কাজে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। এসব সাংস্কৃতিক মঞ্চ সমাজের অবক্ষয়কে দূর করতে সচেষ্ট হবে। কারণ অভাব থেকে আসে হতাশা, হতাশা থেকে সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যহত থাকলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা থাকে না। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করে করোনা পরবর্তী সময়কে উত্তরণের উত্তম পথ ছাড়া আর কিছু নেই বলে আমি মনে করি।

আর এসব করতে হলে শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। যেটি নিয়ে আমার আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। সেই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী দিনগুলোতে শিল্পী ও শিল্পের এই সমস্যা কটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করি। 

সেই সঙ্গে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পূর্বের তুলোনায় যদি আরও বেশি বেশি সঙ্গীতসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তবে শিল্প বাঁচবে, বাঁচবে শিল্পীরা। প্রশ্ন আসতে পারে এজন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অর্থ কোথায় পাবে? এখানেও বিজ্ঞাপনদাতারা ছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। মোট কথা সঙ্গীত যোদ্ধাদের সংকট থেকে উত্তরণে সরকারি-বেসরকারিভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে- অর্থ না থাকলে কেউই চলতে পারবে না। আর অর্থের অভাবে যদি শিল্প বন্ধ হয়ে যায় তবে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লেখক: সঙ্গীত শিল্পী

এনএস/