আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার স্মৃতি
সেলিম জাহান
প্রকাশিত : ১১:৪৭ এএম, ১ জুলাই ২০২০ বুধবার
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছরে পা রাখলো। জন্ম তার ১৯২১ সালের ১লা জুলাই। তার প্রায় ৫০ বছর পরে আমরা পা রেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়অঙ্গনে। ১৯৬৯ এর এক স্নিগ্ধ সকাল থেকে প্রায় পঁচিশ বছর - ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছিল নিত্য আনাগোনা- ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বহু অনন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি, যাঁরা আমাকে ঋদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষকেরা আছেন, আছেন অন্য বিভাগের অধ্যাপকবৃন্দ, আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীবৃন্দ, আছেন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের বন্ধুবর্গও।
অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদা, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতো দিকপালদের আমি শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। অর্থনীতি শাস্ত্রের বহু শিক্ষা, বহু জ্ঞান, বহু বোধ এঁদের কাছেই পাওয়া। বিভাগের বাইরে পেয়েছি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মত মনীষীদের, যাঁরা আমার চিন্তা-চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে লেখালেখি, বেতার- টেলিভিশনে ভাষ্য, সভা-সমিতিতে অংশগ্রহনে কতবার যে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান হয়েছে। বানান থেকে শুরু করে গ্রন্হপন্জী, সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে সম্পাদনা কত বিষয়ে যে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি তার লেখা-জোকা নেই। অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শিদের সঙ্গে ‘একাল’ পত্রিকার কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। মনে আছে আটকে গিয়ে বেশ রাতে ফোন করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’ রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার অংশ, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর ‘রায়তের কথা’ কবে বেরিয়েছিল, তাও জানিয়েছেন অন্য আরেক দিন এক লহমায়। তাঁর কন্যা রুচির আমি শিক্ষক ছিলাম বলে তিনি চিরকাল আমায় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন, এই কিছুদিন আগে ‘তুমিতে’ পদোন্নতি হয়েছে আমার। গত বছর আমার ‘বেলা-অবেলার কথা’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সম্প্রতি ছেড়ে গেছেন তিনি আমাদের।
কি কারণে জানি না, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আমাকে ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলে সম্বোধন করতেন। বাড়ীতে গেলেই বলতেন, ‘এক পিয়ালা চা খাইবেন নি, জনাব সেলিম জাহান?’ ফুলার রোডের দোতালা যে বাড়ীতে থাকতেন তিনি, তার দ্বিতলেই থাকতেন অধ্যাপক মুশাররফ হোসোন ও অধ্যাপক ইনারী হোসেন তাঁদের দুই কিশোর পুত্র জাফর আর রাজাকে নিয়ে। সে বাড়ীতে যাওয়ার পথেই রাজ্জাক স্যারের ডেরায় আমার ঢুঁ মারা। মুনীর কাকার কথা বলতেন খুব, বলতেন আমার পিতার কথাও, যিনি তাঁর ছাত্র ছিলেন। বাজার ও রান্না থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার মুসলমান, হ্যারল্ড লাস্কি থেকে শুরু করে নীরদ চৌধুরী, ঢাকার ইতিহাস থেকে আমার লেখা - কোন কিছুই সে আলোচনায় পরিত্যাজ্য ছিল না। ছাত্রের পুত্র বলে একটি ‘পৌত্র-ছাত্রের’ মতো ব্যবহার ছিল তাঁর আমার প্রতি - গাম্ভীর্যবিহীন, ঠাট্টা- মশ্করার, হালকা চালের। তবে দাবা বিষয়ে তাঁর ত্রিসীমানায় তিনি আমাকে ঘেঁসতে দিতেন না। লক্ষ্য করেছিলাম, আমাকে যেমন তিনি ‘জনাব সেলিম জাহান’ বলতেন, ছফা ভাইকেও সম্বোধন করতেন ‘মৌলভী আহমেদ ছফা’ বলে। আমার ক্ষেত্রের মতো এর কারণও অজানা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাধারণ মানুষের অবিস্মরণীয় চরিত্র আমাকে মানবিক হতে সাহায্য করেছে। অর্থনীতি বিভাগের প্রবাদচরিত্র কানুদা’কে কি করে ভুলি? তাঁর স্নেহ-মমতা আমাকে ঘিরে রেখেছে দীর্ঘ ২৫ বছর - আমার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতা জীবনে। কানুদা’ র পুত্র বাবুল, লাবু, মহসীন আমার আত্মীয়সম। প্রশাসন দপ্তরে খন্দকার সাহেবকে এখনও মনে আছে। বৃত্তির টাকা তুলতে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি জানতেন, হয়ত আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা তিনি প্রায়শ:ই স্মরণ করিয়ে দিতেন। সে শিক্ষা আজও ভুলিনি।
সলিমুল্লাহ হলে নাজু দারওয়ানকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। লম্বা পাগড়ীর, বিরাট গোঁফের নাজু দারেয়ানকে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র বলে মনে হত। শুনেছিলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ২২/২৩ বছর আগে শিক্ষার্থী থাকা অবস্হায় আমার বাবাও নাজুকে সলিমুল্লাহ হলে দেখেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে বাবাকে দেখে নাজু দারওয়ানের চোখে-মুখে সে কি আনন্দের আভা। সে কি যত্ন আত্তি আমার। স্বাধীনতার পরে তাকে আর দেখিনি। ভুলিনি কালুদা’কেও। শিক্ষক থাকাকালীন অবস্হায় তিনি আমার কক্ষের ঝাড়া-মোছা করতেন। শ্রেণিকক্ষ বক্তৃতা করে ফিরলে প্রায়শ:ই বলতেন তাঁর অনুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘স্যার সব সাফা করে দিছি’। ১৯৯২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে আর কালুদা’র সঙ্গে দেখা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জানার বিস্তার এবং আমার সময় কাটানোর পরিসীমার বেশীর ভাগই ব্যাপৃত ছিল শ্রেণীকক্ষের বাইরে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও মিলনায়তন, গ্রন্থাগারের চাতাল, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন - এ সবই ছিল আমার শিক্ষাক্ষেত্র। আড্ডার ঝড় তুলেছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মাঠ ও গ্রন্থাগারের চাতালে - জীবন ও জগতের বহু পাঠ তো সেখান থেকেই নেয়া। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে বিতর্কের যুক্তিতে শাণিত করেছি নিজের চিন্তাশক্তি ও বলনের ক্ষমতা।
আর শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন? সে ছিল এক মহা মিলন ক্ষেত্র। শিল্প-সাহিত্য- সঙ্গীত- চিত্রকলার তীর্থস্থান। কে আসতেন না সেখানে- শেখ লুৎফর রহমান থেকে রফিকুন নবী, কবি নির্মলেন্দু গুণ থেকে শাহরিয়ার কবীর, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে মাহফুজ আনাম। আসতেন কবি আবুল হাসান, সোহরাব হোসেন, অজয় রায়, জাহেদুর রহিম, শওকত আনোয়ার আরো ক’জনা। বাংলা, অর্থনীতি, ইংরেজী আর অন্যান্য বিভাগের দু’এক ক্লাস ওপরের ছাত্র-ছাত্রীসহ আসতো আমার সতীর্থরা। যেমন আসতেন রিজওয়ানুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুক্তাদা, সেলিম সারওয়ার, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ম. হামিদ, তেমনি আসতো কাজী শহীদুল্লাহ, শেখ কামাল, কায়সার হামিদুল হক, ফিরদৌস মুর্শেদ। অনুজদের মধ্যে আতিউর রহমান, হোসেন জিল্লুর রহমান, আনিস আহমেদ আরো কতজন।
দু’একজন মাঝে মাঝে মধ্যে উঁকি দিলেও মেয়েরা আসতো না শরীফ মিয়ায়। তারা ঐ গ্রন্থাগারের চাতালেই বসতো। তাদের জন্যে চা-বিস্কুট নিয়ে যাওয়া হত। হাসিতে-গানে-হৈ-হল্লায় ভরে যেত চারদিক। মনে আছে ঐ চাতালে বসেই একদিন তাজিন মুর্শেদ ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ পুরোটা গেয়ে আমাদের তাজ্জব বানিয়ে দিয়েছিলো। শেখ কামাল কোরাসে ‘পাগলার মন নাচাইয়া, পাগলী গেল চলিয়া’- তার স্বরে চিৎকার করে গেয়েছিলো।
শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে কত কি যে শিখেছি। হাসান ভাই একদিন ছন্দের শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমার বাল্যবন্ধু প্রয়াত শিল্পী হাসি চক্রবর্তী বুঝিয়েছিলো রেখার টান বিষয়ে। শুদ্ধ কবিতার জন্য কবিতা, না সমাজ-চিন্তার জন্যে কবিতা - এ বিতর্কে একদিন রেগেমেগে শাহনূর খান বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ কথা বলেননি আমার সঙ্গে। নভেরার ভাস্কর্যের ব্যাখ্যা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল খান মোহাম্মদ ফারাবীর সঙ্গে। ঐ চাতালের আড্ডা থেকেই কামাল একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিল এদের ৩২ নম্বরের বাড়ীতে- সেই একবারই জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি হবে। ভাবতে অবাক লাগে যে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমারও চেনা-জানার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা বয়সের সুতো ধরে অনেক দূর এগিযেছি, হারিয়েছি বহু শিক্ষককে, চলে গিয়েছে বহু সতীর্থ বন্ধু। কিন্তু আমরা- ৬৯ আর ৭১ এর সন্তানেরা- এখনো আছি - হাত ধরে আছি পরস্পরের। যখন পেছন ফিরে তাকাই, মনেই হয় না এত দিন পেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের যে দিন গেছে, তা রাতের তারার মতো দিনের আলোর গভীরে আছে কিনা জানি না। তবে নিশ্চিত জানি, তারা আছে আমাদের সবার হিরন্ময় স্মৃতিতে।
এমবি//