শুনশান নিরবতায় হাবিপ্রবি ক্যাম্পাস
আব্দুল মান্নান, হাবিপ্রবি:
প্রকাশিত : ১০:১৬ পিএম, ১ জুলাই ২০২০ বুধবার | আপডেট: ১০:১৮ পিএম, ১ জুলাই ২০২০ বুধবার
প্রায় সাত বছর ধরে ক্যাম্পাসে আছি। কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। এবার পুরো বিশ্বকে এমনই এক পরিস্থিতিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। সারাবিশ্ব আজ এক অজানা অচেনা অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে লড়াই করে চলেছে। বাচা-মরাই এই লড়াইয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত বা আক্রান্ত হয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ।
ঘাতকব্যাধি করোনার ছোবল থেকে রেহাই পায়নি লাল-সবুজের বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ২ হাজারের মতো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে অন্যদিকে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ৮ ই মার্চ ২০২০ ইং। এরপর ধীরে ধীরে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং সারাদেশে বিস্তৃত লাভ করে। করোনার সংক্রমণ এবং বিস্তাররোধে সরকার শুরুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয়।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৮ মার্চ হতে পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ রাখার সিন্ধান্তে পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ আগামী ৬ই আগস্ট পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং তা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়তে পারে বলেও বার্তা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিগত তিন মাসের অধিক সময় ধরে গৃহবন্দী জীবন পার করতে হচ্ছে অনেককেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একটানা এতটা সময় ধরে এর আগে কখনো থাকা হয়নি। কিন্তু করোনার কারনে অনেকটা বাধ্য হয়েই এবার বাসায় অবস্থান করতে হচ্ছে। বাড়িতে দুধেভাতে থাকলেও প্রিয় ক্যাম্পাসকে এক নজর দেখতে মন ছটফট করছিল। ঝুকি নিয়েই প্রিয় ক্যাম্পাসকে এক নজর দেখতে ছুটে যাই দিনাজপুর। বাসায় থেকে মনে মনে ক্যাম্পাসের যেসব পরিবর্তন ভাবছিলাম ক্যাম্পাসে এসে তার চেয়েও বেশি পরিবর্তন চোখে পড়েছে।
রবিবার আনুমানিক দুপুর ১২ টার দিকে ক্যাম্পাসে পৌঁছাই। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো।তারপরেও ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে প্রথমেই শ্রদ্ধাভাজন দুই শিক্ষকের সাথে দেখা। আমাকে দেখে দুজনেই কেন ক্যাম্পাস আসছি তার কারন জানতে চাইলেন। আমি বাসায় দীর্ঘদিন থেকে বিরক্তি লাগার কথা জানালাম। এটুকু শুনে পাশ কেটে স্যাররা চলে গেলেন। আর আমি ঘুরে ঘুরে করোনাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছবি ও ভিডিও করলাম স্মৃতিতে আবদ্ধ করে রাখতে।
ক্যাম্পাস যখন খোলা ছিল তখন প্রতিদিন সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠত ছোট্ট এই ক্যাম্পাস। তারপর দিনভর চলতো ক্লাস-পরীক্ষার ব্যস্ততা। সারাদিনের ক্লান্তিতে সূর্য অস্ত গেলেও থামেনি কখনো গল্পের পসরা সাজিয়ে বসা বন্ধুত্বের আড্ডা। রাতের ক্যাম্পাস ছিল আরও মুখর, মধ্যরাতের চায়ের কাপে প্রতিটা চুমুকেই মিশে থাকত জয় পরাজয়ের গল্প,জীবন সংগ্রামে হার না মানার গল্প, স্নাতকোত্তর ছেলের বেকারত্ব আর হতাশার গল্প। আর রাত বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পাস সিঙ্গারদের বসতো গানের আসর- কখনো ব্যান্ড কখনো লালনগীতি আবার কখনো অপছন্দের গান বিকৃত করেও গেয়ে চলত অনেকে। করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধে সেই চাঞ্চল্যতা আর মুখরতা আজ নেই। সব নিরব ও নিস্তব্ধ হয়ে আছে। প্রকৃতি তার আপন রূপে সেজেছে। প্রিয় হাবিপ্রবি ক্যাম্পাস আবির্ভূত হয়েছে এক নতুন রুপে নতুন সাজে।
বিরামহীন হেঁটে চলা ধূলোর পথগুলো এখন সবুজ ঘাসে ঢাকা। টিএসসি, লাইব্রেরী চত্ত্বরের যেখানে প্রতিনিয়ত আড্ডার আসর বসতো সেখান এখন বড় বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা।গাছে গাছে বিভিন্ন ফুল ফুটেছে, ডালে ডালে নতুন কুশি গজিয়েছে। রুক্ষতা হারিয়ে সবুজ ও সতেজ হয়ে উঠেছে গাছ গুলো। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আম, জাম, লিচু, কাঠাল গুলো পরিপক্ক হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যেতো।দলবেঁধে হুই হুল্লোড় করে গাছে উঠে যে যার মতো করে পেড়ে খেতো। করোনায় এবার সেই সুযোগ পায়নি শিক্ষার্থীরা। তাই গাছে গাছে ফলের ঝোকা গুলো বাড়িয়েছে নতুন এক সৌন্দর্য।
আবাসিক হল গুলোতে দিনরাত হই-চই লেগে থাকতো। হল ভ্যাকেন্ট থাকায় কোন শিক্ষার্থীর হলে থাকার সুযোগ নেই এখন। অন্যদিকে হল সমূহের পানি এবং বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। হই-চই মুখর হলগুলোতে এখন একটা ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। যেখানে ক্লাস শেষে গাড়িতে উঠার জন্য ভীড় জমে যেতো। সেই জায়গাটিও আজ সুনসান নিরব।নীল -বেগুনি রংয়ের গাড়ি গুলো এখন সারিবদ্ধ ভাবে পড়ে আছে। সিট পেতে সবার আগে গিয়ে টার্মিনালে এখন দাঁড়িয়ে থাকার যেন কেউ নেই। জাতীয় দিবস গুলোতে শহীদ মিনার ফুলেল শ্রদ্ধায় সজ্জিত হতো কিন্তু এ বছর সেই সজ্জা নেই। ক্লাসের শেষে বন্ধু বান্ধব বসে খুনসুটি করার মানুষ নেই এখন আর। সবই যেন এখন স্মৃতি।
ক্যাম্পাস চলাকালে জন্মদিনের কেক কাটার জন্য রিমা চত্ত্বর, টিএসসি,শহীদ মিনার,স্কুল মাঠে সিরিয়াল পড়ে যেতো করোনা সেই আনন্দটুকুও সবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। প্রকৃতির সাজে সাজলেও শিক্ষার্থী শুন্য ক্যাম্পাস যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। খাতা-কলম নিয়ে ছুটে চলার যে কর্মব্যস্ততা তা যেন এখন শুধু কল্পনাতে রয়েছে।ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় আবার কবে ক্যাম্পাস মুখর হয়ে উঠবে, সবাই একসাথে মিলে আড্ডা দিতে পারবো। বাসায় বসে এখন এই অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে সবাইকে।
আরকে//