ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ: নারী পথিকৃৎ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:০৯ পিএম, ২ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার
‘একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে - আছেন এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথককৃত এবং সুরক্ষিত এক অতি সুকুমার উপবংশ। আমরা জন্মেছিলুম স্ত্রীলোকহীন জগতে - এ কথাটা রবীন্দ্রনাথ যে-অর্থে বলেছিলেন, তাঁর পৌত্রের বয়সী আমাদের জীবনেও সে-অর্থে প্রযোজ্য ছিল’। ১৯২৭-২৮ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী- শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ‘আমার যৌবন’ গ্রন্থে বুদ্ধদেব বসুর দেয় বর্ণনা নিয়ে কথা বলছিলাম আমার এক সহপাঠিনীর সঙ্গে।
ঐ বর্ণনার চার দশক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি ছাত্র হয়ে, তখন চালচিত্র অনেকখানিই বদলে গেছে। ১৯৬৯ সালে আমরা যখন অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখন ১৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এক তৃতীয়াংশই ছিল মেয়ে। দু’টো শাখার মধ্যে ‘ক’ শাখাতেই আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন ৪৮ জনের মতো, ‘খ’ শাখাতে মাত্র ২ জন। ‘এমন অসমতা দেখে নি কোথাও কেউ’ - এমন কথা অর্ধ-শতাব্দী পরেও আমার ‘খ’ শাখার বহু সতীর্থই বলে থাকেন। ভাগ্যিস, আমি ‘ক’ শাখাতে ছিলাম, নইলে অবস্থাটা আমার ঐ বুদ্ধদেব বসুর জগতের মতোই হয়ে যেত।
‘অর্থনীতিতে তো মেয়েরা তেমন আসতো না। বহু বাঁধ তো আমরাই ভেঙ্গেছি,’ গর্বের উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা সহপাঠিনীর সারা মুখে। ‘আর কি সব তুখোড় মেয়েরা ছিলো আমাদের সঙ্গে - এক ঝাঁক প্রতিভা-হীরক যেন’, ঝলমল করে ওঠে তার মুখ। সে না বললেও আমি তো জানি, ঐ হীরক খন্ডের একটি দ্যুতিময় অংশ সে নিজেও।
সহপাঠিনীটি চলে গেলে পরে ওর একটি কথার তরঙ্গ আমার চেতনার তটে বারংবার আছড়ে পড়তে লাগল- ‘অর্থনীতিতে মেয়েরা তো তেমন আসতো না। বহু বাঁধ তো আমরাই ভেঙ্গেছি’। না, সেটা পরিপূর্ণ ভাবে সঠিক নয়। আসলে নারী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে অর্থনীতি বিভাগে বাঁধ ভাঙ্গার শুরু হয়েছিলো বহু আগে - বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই।
সুষমা সেনগুপ্ত অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯২১ সনেই - যে বছর কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর পিতা সুসাহিত্যিক অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষক ও জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। প্রতিষ্ঠা লগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যে দু’জন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁর একজন সুষমা সেনগুপ্ত, অন্যজন সর্বজনবিদিত লীলা নাগ (রায়)। ঢাকায় যখন ‘দীপালি সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন লীলা নাগ ও সুষমা সেনগুপ্ত তার যুগ্ম-সম্পাদিকা হলেন। ত্রিশের দশকে পিত্রালয়ে স্থান করেছিলেন ‘নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’, ৫০ বছরের ওপরে ছিলেন কোলকাতার ‘লেক স্কুল ফর গার্লসের’ অধ্যক্ষা, ভূষিত হয়েছিলেন ভারতের ‘জাতির বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ’ সম্মানে, লিখেছিলেন ‘চিরন্তনী’, ‘আগামী’, ত্রিস্রোতার’ মতন বই।
প্রথম ছবিটি লীলা নাগের, দ্বিতীয়টি নাজমার সঙ্গে লেখক।
অর্থনীতি বিভাগের প্রথম মহিলা শিক্ষক অমিতা চৌধুরীর কথা প্রথম শুনেছিলাম আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক মীর্জা নূরুল হুদার কাছে (অধ্যাপক এম.এন. হুদা নামেই যাঁর পরিচিতি সমধিক)। অমিতা চৌধুরী অধ্যাপক হুদার দু’বছরের কণিষ্ঠ ছিলেন। সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন ১৯৪১ সালে এবং খুব অল্পের জন্যে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পাননি অমিতা চেধুরী। পরবর্তী সময়ে বৈবাহিক সূত্রে তিনি রায় পদবী গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে তিনি যোগদান করেন ১৯৪৫ সালে, কিন্তু এক বছর পরেই শিক্ষকতা করতে দিল্লী চলে যান। আবারো বলি, অর্থনীতি বিভাগে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা শিক্ষক। ছাত্রী থাকাকালীন অবস্থায় অমিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিশ্বব্যাংকে ভারতের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক হুদার সতীর্থ ড: সমর সেন সত্তর দশকের প্রথমার্ধে ঢাকায় এলে অমিতা চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করেছিলেন।
আজ বড় গর্বের সঙ্গে বলি, আমার এক সময়ের শিক্ষার্থী নাজমা বেগম (বর্তমানের অধ্যাপক নাজমা বেগম) অর্থনীতির প্রথম নারী বিভাগীয় প্রধান ছিলেন বছর কয়েক আগে। ১৯২১ সালে বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলেও দশ দশক লেগেছে একজন নারীকে বিভাগের কর্ণধার হতে।
ভারতলক্ষ্মী মুখেপাধ্যায়ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি অর্থনীতির প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন খুব সম্ভবত: ১৯৩৬ সনে। তাঁর ঐচ্ছিক বিষয় দু’টো ছিল ইংরেজী ও গণিত। ভারতলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায় ১৯৪৮ সালে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন, কিন্তু ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। তাঁর বাড়ী-ঘর লুণ্ঠিত হয়। তখন তিনি পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তাঁর কথা সত্তরের দশকে ড: মাজহারুল হকের মুখে শুনেছি বহুবার।
অর্থনীতির ছাত্রী রেনুকা সেনগুপ্ত এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৩১ সালে। কিন্তু তিনি খ্যাতি লাভ করেন তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্যে। রেনুকা সেনগুপ্ত লীলা নাগের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে রেনুকা সেনগুপ্তের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ১৯৪১ সালে শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীর গুলিতে কুমিল্লার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স নিহত হলে রেনুকা সেনগুপ্তকে বিশেষ আইন বলে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৭ বছর পরে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পরে তিনি লীলা নাগ ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বর্ণোজ্জ্বল পথযাত্রার অংশ হবার সৌভাগ্য আমাদের যাদের হয়েছে, তারা অনেকেই এ ইতিহাস জানি না, বিশেষত: প্রথম দিকের নারী শিক্ষার্থীদের কথা ও তাঁদের ভূমিকা। আমি শুধু আমার জানা অর্থনীতি বিভাগের ক’জন পথিকৃৎ নারী শিক্ষার্থীর কথা উল্লেখ করেছি, কিন্তু আমি নিশ্চিত, বহু ইতিহাসই অজানা আমাদের কাছে। এ সব ইতিহাসের সংরক্ষণ বড় প্রয়োজন। এ ইতিহাস না জানলে সামনে এগুবো কি করে? গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দিল, আগামী বছর এ শিক্ষায়তনের শতবর্ষ পূর্ণ হবে -যার প্রেক্ষিতে তার ক্ষেত্রে তো এ প্রয়োজন তো আরও বেশী।
এনএস/