দিনমজুর থেকে যেভাবে কোটিপতি মাছ চাষী চঞ্চল
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:১৭ পিএম, ২ জুলাই ২০২০ বৃহস্পতিবার
পুরস্কার হাতে চঞ্চল হোসেন ও তার সহকর্মীরা।
অভাবের সংসারে অর্থাভাবে চতুর্থ শ্রেণিতেই লেখাপড়ার ইতি টানেন। শুধু ভাতের জন্যই ১১ বছর বয়সে হ্যাচারী শ্রমিকের কাজ নেন। তিনবেলা খাবারের জন্য অন্যের হ্যাচারীতে কাজ করতেন। মাছ ব্যবসা করে তিনি এখন কোটি টাকার মালিক। বলছিলাম, নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার কাশিমালা গ্রামের চঞ্চল হোসেন (৩৫)-এর কথা। উদ্যোক্তা যুবকদের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণের নাম।
টানা ১১ বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পর মাত্র ৯ হাজার টাকা দিয়ে ছোট করে হ্যাচারি দিয়ে শুরু করেন। প্রথমে ছিল দেশীয় মাগুর মাছের রেণু থেকে পোনা মাছ উৎপাদন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন শুধু দেশীয় মাছের ডিম ও পোনা উৎপাদন করে নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার কাশিমালা গ্রামের চঞ্চল হোসেন স্বাবলম্বী।
চঞ্চল এখন শুধু সফল মাছ চাষীই নন, দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে একজন সফল গবেষকও। সে নিজেই মা মাছ থেকে ডিম, রেণু ফুটানো সকল কাজ দক্ষতার সাথে করতে পারেন। এখন তিনি নওগাঁর মানুষের কাছে রোল মডেল। মৎস্য চাষের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দু’বার পুরস্কার পেয়েছেন।
অথচ অভাবের কারণে বেশি দূর এগোতে পারেনি তার পড়াশোনা। ২০০১ সালে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। মাছের আড়তে কাজ করার সময় চঞ্চল দেখতে পান দেশীয় মাছের দাম অন্য মাছের তুলনায় বেশি। এরপর বিলুপ্ত প্রজাতির দেশীয় মাছের রেণু উৎপাদনের চিন্তা মাথায় আসে তার। মাছের আড়তে কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু করার পরিকল্পনা করেন। এরপর ২০১২ সালে ৯ হাজার টাকা দিয়ে নিজেই একটি পুকুরে দেশীয় মাগুর মাছ চাষ শুরু করেন। পাঁচ কেজি দেশীয় মাগুর মাছের রেনু দিয়ে ৪০ দিন পর প্রায় সোয়া দুই লাখ পোনা প্রতিটি দুই কাটা করে বিক্রি করে সাড়ে চার লাখ টাকা আয় করেন।
এমন সফলতা পাওয়ায় পরের বছর ছোট করে একটি হ্যাচারী করেন। যেখানে ডিম থেকে পোনা মাছ উৎপাদন হতো। পরে আরো দুইটি হ্যাচারী করেন চঞ্চল। পর্যায়ক্রমে এখন তিনি ৭টি পুকুরে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ চাষ করেন। এর মধ্যে ১টি পুকুর তার নিজের এবং ৬টি লিজ নেয়া। হ্যাচারী রয়েছে তিনটি। এখন নিজে জমি কিনে ৬টি পুকুর খনন করেছেন। মাছ চাষ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন দেশীয় মাছের রেণু সংগ্রহ করা ছিল কষ্টকর। এক সময় ডিম/রেণুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজেই বাড়িতে শুরু করেন দেশীয় মাছের রেণুর হ্যাচারি। বড় মেয়ে সুবর্ণার নামে খামারের নাম দেন ‘সুবর্ণা মৎস্য হ্যাচারি’। বছর বছর বাড়তে থাকে রেণুর চাহিদা।
ব্যক্তিগত জীবনে চঞ্চল তিন সন্তানের জনক। বড় মেয়ে সুবর্ণা স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে, দ্বিতীয় মেয়ে সখি প্রথম শ্রেণীতে পরে এবং সবার ছোট ছেলে সৌরভ।
হ্যাচারিতে দেশীয় শিং, মাগুর, টেংরা, গুলসা টেংরা, পাবদা, কৈ, চিতল, গুচি, পুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ ও বাইমসহ কয়েক প্রজাতির মাছের রেণু উৎপাদন করা হয়। চঞ্চল বলেন, ‘হ্যাচারি থেকে প্রতিমাসে প্রায় এক হাজার কেজি রেণু উৎপাদন করা সম্ভব। বর্তমানে চঞ্চলের হ্যাচারি মাছের খামারে কর্মরত আছে ২১ জন লোক। এর মধ্যে স্কুল কলেজে পড়া শিক্ষার্থীও কর্মরত আছেন। যারা লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করছেন।’
তার খামার থেকে বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় রেণু সরবরাহ করা হয়ে থাকে। চঞ্চল মনে করেন, ‘সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে শিক্ষিত তরুণরা দেশীয় মাছ চাষে এগিয়ে আসলে ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবে।’
সফল খামারি চঞ্চল হোসেন বলেন, ‘এক সময় ডোবায়ও দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানি খাল, নদী ও ডোবাতে যাওয়ার ফলে সেসব মাছ মারা যায়। এতে করে দেশীয় মাছ এখন বিলুপ্ত প্রায়।’ সেই চিন্তাধারা থেকে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতেই দেশীয় মাছের রেণুর হ্যাচারি করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বর্তমানে এখন তার খামারে প্রায় দেড় কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। চঞ্চলের কাছে ঋণ নেয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মকর্তারা আসলেও তিনি এখন নিজ অর্থায়নে কাজ করছেন।
এনএস/