ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

যেসব কারণে জাপানে করোনায় মৃত্যু হার কম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১১ পিএম, ৫ জুলাই ২০২০ রবিবার

চীনের পর করোনার প্রথম দিকে বড়ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয় জাপানকে নিয়ে। ওই সময়ে প্রমোদতরী ডায়মন্ড হারবাল জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে করোনা সংক্রমণ। আর তাই কোন দেশই এই জাহাজটিকে নোঙর করতে দেয়নি তখন। কিন্তু জাপান তার বন্দরে ডায়মন্ড হারবাল জাহাজটিকে নোঙর করায়। এ থেকেই শঙ্কা সৃষ্টি হয় এবং এর পরই দেশটিতে কোভিড-১৯ শনাক্ত হতে থাকে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা অন্য কোনও দেশের চেয়ে অনেক কম জাপানে।

জাপানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ২৮২। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৯৭৭ জনের। দেশটিতে মৃত্যু হার কম হওয়ার পেছনে নানা তত্ত্ব আলোচনায় উঠে আসছে। কেউ বলছে এর পেছনে রয়েছে জাপানীদের মন-মানসিকতা, তাদের সংস্কৃতি, আবার কারো মত হল জাপানীদের ইমিউনিটি অসাধারণ।

জাপানে তখন কী ঘটেছে?
বয়স্ক মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর যে কোন দেশের চেয়ে জাপানে বেশি। জাপানের বড় বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যা ব্যাপক, শহরগুলো মানুষের ভিড়ে ঠাসা। এর পরেও ইউরোপের দেশগুলোর মতো জাপানে সেভাবে কোন লকডাউন হয়নি। ঘরের ভেতর থাকার জন্য কোন বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি হয়নি।

শুধু অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং সেটা ছিল মানুষের স্বেচ্ছানির্ভর। জরুরি নয় এমন দোকানপাট ও ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তা না মানলে কোন আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান রাখা হয়নি।

এমনকী সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ - "টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট" উপেক্ষা করেছে জাপান। দেশটিতে পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৪৮ হাজার মানুষকে। যা জাপানের  জনসংখ্যার ০.২৭%।

তাহলে অন্যান্য অনেক দেশের মত সীমান্ত বন্ধ না করে, কঠোর লকডাউন না দিয়ে, ব্যাপক হারে পরীক্ষা না চালিয়ে আর কড়া কোয়ারেন্টিন না দিয়েও জাপান কীভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম রাখতে পারল?

জাপানের বহু মানুষ এবং অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন জাপানের ক্ষেত্রে একটা কিছু আছে যা আলাদা। একটা কিছু যা কোভিড-১৯ থেকে জাপানের মানুষকে রক্ষা করেছে।

তাহলে ‘আলাদা’ কিছু কী ইমিউনিটি?
টোকিও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাতসুহিকো কোদামা জাপানের রোগীদের ওপর এই ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। তার ধারণা, জাপানে হয়ত আগে কোভিড হয়েছে। কোভিড-১৯ নয়, তবে একই ধরনের জীবাণুর অতীত সংক্রমণ জাপানের মানুষকে “ঐতিহাসিক ইমিউনিটি” দিয়েছে।

তিনি বলছেন, “কোন ভাইরাস যদি প্রথমবার আক্রমণ করে তখন প্রথমে সক্রিয় হয়ে ওঠে আইজিএম অ্যান্টিবডি, পরবর্তীতে সক্রিয় হয় আইজিজি। পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমরা খুবই অবাক হয়েছি যে সব রোগীর ক্ষেত্রে প্রথমেই দ্রুত সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে আইজিজি অ্যান্টিবডি, এরপর আইজিএম অ্যান্টিবডিও সক্রিয় হয়েছে কিন্তু সেটা পাওয়া গেছে খুবই সামান্য পরিমাণে। এর মানে হল আগে একইধরনের ভাইরাস এদের সবার শরীরে ঢুকেছিল।"

জাপানের করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সাফল্যের পেছনে রয়েছে সামাজিক ট্রান্সমিশান, যা নাটকীয়ভাবে সংক্রমণ কমাতে পেরেছে।

জাপানের মানুষ ১৯১৯এর ফ্লু মহামারির পর থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফেস মাস্ক পরা শুরু করেছে। তারা একশ বছরের এই অভ্যাস এখনও ছাড়েনি। জাপানে কারও কাশি হলে বা ঠাণ্ডা লাগলে, সে অন্যদের সুরক্ষিত করতে সবসময় মাস্ক পরে।

জাপানের ট্র্যাক এবং ট্রেস ব্যবস্থা অর্থাৎ সংক্রমিতকে খুঁজে বের করে তার সংস্পর্শে কারা এসেছে সেটা নজরে রাখার ব্যবস্থাও বহু পুরনো। নতুন কোন জীবাণুর সংক্রমণের খবর আসলে আক্রান্তদের চিহ্ণিত করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু আছে দেশটিতে।

এই মহামারির বেশ শুরুর দিকে জাপান দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করেছিল। তারা দেখেছিল একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং তারা একই ধরনের জায়গায় যায়।

কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষক ড. কাজুয়াকি জিন্দাই বলেন, “আমরা দেখেছিলাম বেশিরভাগ আক্রান্ত মানুষ গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। কারাওয়াকি ধাঁচের গানের জলসা, পার্টি বা ক্লাবে হৈচৈ চিৎকার করে আনন্দ উল্লাস, পানশালায় গালগল্প এবং জিমে ব্যায়াম - যেখানে মানুষ পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে, মেলামেশা করে এবং জোরে কথা বলে- জোরে নি:শ্বাস নেয়, সেসব জায়গায় ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি খুব বেশি। তাই আমরা সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের জায়গায় যাওয়া বন্ধ করতে হবে বলি।”

দ্বিতীয়ত, তারা দেখে যে যারা আক্রান্ত তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। সার্স কোভি-২ যখন হয়, তখন গবেষণায় দেখা গিয়েছিল আক্রান্তদের মধ্যে ৮০% ভাইরাস ছড়ায় না, তাদের মাত্র ২০% খুবই সংক্রামক হয়। এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকার জাতীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালায় এবং বলে তিনটা জিনিস যেন তারা এড়িয়ে চলে:

* বদ্ধ জায়গা যেখানে বাতাস চলাচল ভাল না
* ভিড়ে ভর্তি জায়গা যেখানে অনেক মানুষ
* খোলা নয়, এমন জায়গায় মুখোমুখি বসে গল্প করা

এই পরামর্শ কাজে দিয়েছে দেশটিতে। লোকে সতর্ক হয়েছে, সংক্রমণ এড়িয়েছে এবং সংক্রমণ কম হবার কারণে মৃত্যুও হয়েছে কম। 

এছাড়া জাপান সরকারের নির্দেশ ছিল- নিজের যত্ন নিন, ভিড় পরিহার করুন, মাস্ক পরুন, হাত ধোন- মানুষ অক্ষরে অক্ষরে এই সব কটি পরামর্শ নিজেদের স্বার্থেই মেনে চলেছে। তাই দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর হার অনেকটাই কম।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনেজা আবে গত মাসের শেষের দিকে বেশ গর্বের সঙ্গে এটাকে "জাপান মডেল" হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, অন্য দেশের জাপান থেকে শেখা উচিত। সূত্র বিবিসি

এএইচ/