এন্ড্রু কিশোর আমাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছেন
লুৎফর হাসান
প্রকাশিত : ০৯:৩৩ এএম, ৭ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার
স্মৃতিকথা লিখতে গেলে ঘুরেফিরে আমাদের সেই গ্রামের কথাই প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে। বলতে গেলে সামনে আসে গ্রামে কাটানো জীবন। সেই অদ্ভুত কুয়াশায় মোড়ানো শিউলির ঘ্রাণ ছড়ানো সকালবেলার কথা আসে। নাইন অ’ক্লক বা লাল গোলাপি ঘাসফুলের কথা আসে। দোপাটির চোখ খুলে যাওয়া ভর দুপুরের কথা আসে। আর আসে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। অনুরোধের আসর গানের ডালি। বেবি লজেন্স সঙ্গীতমালা। বাটা গীতমালা। আমাদের কানের কাছে আরামে কথা বলে ওঠেন মাজহারুল ইসলাম ও নাজমুল হোসাইন অথবা হেনা কবির। অসংখ্য গানের মাঝখান থেকে আলাদা হয়ে আমাদের ভাসিয়ে নেন এন্ড্রু কিশোর। তুমি আজ কথা দিয়েছ, বলেছ, ও দুটি মন ঘর বাঁধবে, একাকী জীবনে তুমি আসবে।
আমাদের সাথে এন্ড্রু কিশোরের প্রথম দেখা হয়েছিল শৈশবে। একদম চালতার আচারে উঠোন ভরে থাকা নরম রোদের শৈশব। বুড়ো ছাতিম গাছের উপরে মাইক বেঁধে কে যেন আমাদের শুনিয়েছিল ‘এক চোর যায় চলে, এ মন চুরি করে, পিছে লেগেছে দারোগা, ধরা পড়ে গেছ, রেহাই পাবে না তো, পরবে প্রেমের হাতকড়া’। আমরা দারুণ নেচেছিলাম সেই ভর দুপুরে। ফিতা টেনে টেনে আমরা শুনেছিলাম সেই গান। বাংলাদেশের মানুষের নাম এমন ইংরেজি হয়? শুনলাম সেদিনই। মানে আমরা এই জগতের সবকিছু নিয়েই বিপুল বিস্ময় নিয়ে থাকতাম।
এন্ড্রু কিশোরের সাথে আমাদের আরও একটু সম্পর্ক ঘন হয় সাদাকালো টেলিভিশনে। সেটা রবিবারের রাত দশটার ইংরেজি সংবাদের পর ছায়াছন্দে। আমরা নদী পার হয়ে জামতৈল বা বেলুয়া যেতাম। নিজেদের গ্রামে টেলিভিশন ছিল না। সেই ছায়াছন্দ শুরু হতেই ইলিয়াস কাঞ্চন ঠোঁট মেলাচ্ছেন ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’। ফেরার পথে আমরা সেই গান গুনগুন করি। আমাদের পথ কমে আসে। এত গানের মধ্যে ওই কণ্ঠটা আমাদের কাছে সত্যিই আলাদা মনে হয়।
এন্ড্রু কিশোরের সাথে আমাদের পুরোপুরি সম্পর্ক হয় মূলত শীতকালে। সর্ষে ক্ষেতের আলে বসে আমরা আলু পুড়িয়ে খেতে খেতে পাশেই রেডিও শুনতাম। রোদ এসে শুয়ে থাকতো আমাদের পাশেই। নাজমুল হোসাইন বা মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে গানের আগের সেই প্রাক কথন। তারপর ‘ পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’ অথবা ‘তুমি আমার কত চেনা, সে কি জানো না’।
তারপর দুরন্ত দিন। বাইসাইকেলে পঙ্খীরাজের প্রেম। বাতাসের আগে আগে আমাদের পাল্লা দেয়া জীবন। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে কাকলি, মানসি, কল্লোল, মাধবী সিনেমা হল। রুবেলের ঠোঁটে ‘ যেখানে আমার প্রাণ আছে, যেখানে আমার হৃদয় আছে’, জসিমের ঠোঁটে ‘শূন্য এই হাতে হাত রেখে, তুমি আজ কথা দাও না’, মান্নার ঠোঁটে ‘সুন্দর সন্ধ্যায় এ গান দিলাম উপহার’। যেন সব একাকার । একই রকম মিলে যায়। আমরা সাধারণত নায়কের সাথে গায়কের মিলে যাওয়া দেখতাম। এ দিক দিয়ে এন্ড্রু কিশোর যেন সবার সাথেই মিলে যেতেন।
সৌভাগ্যই বলতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেবার ভর্তি হয়েছি। সমাবর্তনের বিরাট আয়োজন। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে একটুও জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে আমরা একদম মঞ্চের সামনে। মঞ্চে উঠলেন সেই জাদুকর। উঠেই ধরলেন গান ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, হো ও ও’। পুরো স্টেডিয়াম যেন একসাথে গেয়ে উঠলো। তারপর একে একে ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’। শেষে গাইলেন পড়ে না চোখের পলক, কী তোমার রূপের ঝলক। কুড়ি বছর আগের সেই সন্ধ্যার কথা আমাদের এখনও ঠিক মনে আছে।
আমরা এক জীবনে অনেকের গানেই বুঁদ হই, ভাসি ডুবি আরও কত পাগলামি করি। কিন্তু একজন শিল্পীর এতগুলো গানে আমাদের মুগ্ধতা, তাও আবার কৈশোরের স্মৃতিতে আঁকড়ে থাকা, এ একদম ছোট কিছু নয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। এন্ড্রু কিশোর আমাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছেন।
ভালো থাকবেন দাদা। শ্রদ্ধা।
লেখক: গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী
এমবি/