ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

সংকট কাটিয়ে উঠছে পোশাক খাত

রিজাউল করিম 

প্রকাশিত : ০৯:৫৮ পিএম, ১০ জুলাই ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ১০:১৪ পিএম, ১০ জুলাই ২০২০ শুক্রবার

করোনায় সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। সরকার পোশাক শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান দিচ্ছে। শ্রমিকরাও এখন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজাই রেখে কাজে যোগ দিয়েছে। এতে কারখানার উৎপাদন আগের তুলনায় বাড়ছে। কয়েক মাস আগে স্থগিত ও বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশও ফিরে আসছে। ফলে পোশাক পণ্যের রফতানি আয়ও বাড়ছে। যা সামগ্রীকভাবে খাতটির করোনা ধাক্কা কাটিয়ে উঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, করোনার ভয়াবহ ছোবলে গত মার্চ মাসে দেশের তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়ে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের একক বৃহত্তর বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রসহ সেই সব দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি দেশে করোনা দেখা দেয়। ফলে দেশগুলো স্বাস্থ্য ঝুঁকি সহ অর্থনৈতিক দৈন্যতায় পড়ে যায়। সেসব ক্রেতাদেশগুলোর করোনা ঝুঁকির নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়ে। সেসব দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নতুন কোন ক্রয়াদেশ বন্ধ করে দেয়। এমনকি আগের দেওয়া ক্রয়াদেশগুলো স্থগিত ও বাতিল করে দেয়। যার প্রভাবে মার্চ মাসে দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ দখলকারী পোশাক শিল্পের উৎপাদন ও আয়ে খরা দেখা দেয়। কিন্তু গত চার মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ পোশাক শিল্প ধীরে ধীরে সে ঝুঁকি ও রপ্তানি আয়ের ভাটা কাটিয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চলতি বছরের মার্চে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমে ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ। এরপর এপ্রিলে কমে ৮৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর মে মাসে কমে ৬২ শতাংশ। জুনেও রপ্তানি কমার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। কিন্তু তার ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হার আগের তুলনায় কম। অর্থাৎ মাত্র ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, এ বছরের মার্চ থেকে আমাদের পোশাক রপ্তানির অবাধ পতন ঘটছে। জুনে অবস্থা তুলনামূলক ভালো হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। বাস্তবেও হয়েছে তাই। পতনের হার কমে এসেছে। ক্রেতারাও আগের তুলনায় ক্রয়াদের বাড়াচ্ছে।

জানা যায়, করোনার প্রথম থাবা বা উৎপত্তি গত ডিসেম্বরের শেষে চীনের উহানে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রথমে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে। এ অবস্থায় একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও আছে। তবে এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ বহাল রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ফলে সামনের দিনগুলোয় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

এদিকে বৈশ্বিক লকডাউন পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে নতুন ক্রয়াদেশও আসতে শুরু করেছে পোশাক কারখানাগুলোতে। কারখানা মালিকরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কারখানাগুলো একদিকে যেমন পোশাকের নতুন আদেশ পাওয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে তেমন করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্ব চাহিদা মাথায় রেখে নতুন ভিন্ন ধরণের পোশাক পণ্য তৈরি করছে। মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই বানিয়ে দেশের তৈরি পোশাক খাত সংকট কাটিয়ে উঠছে। বিশ্ব বাজারে নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে সক্ষম হচ্ছে। যা ফরাসি বার্তা সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

লকডাউনের কারণে অনেক পোশাক শ্রমিক কাজ হারালেও ঢাকার অদূরে সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় পুরোদমে চলছে কাজ। এসব কারখানায় এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম- এমন নিরাপত্তা সরঞ্জাম বানিয়ে তা পশ্চিমা দেশগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। শ্রমিকরা এসব কারখানায় সপ্তাহে ৬ দিন দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে কাজ করছেন। তারা মূলত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সবচেয়ে বেশি বানাচ্ছেন। এছাড়া ফেস মাস্ক ও গ্লাভসের চাহিদাও আছে পশ্চিমা দেশগুলোতে।

বেক্সিমকো গার্মেন্টসের প্রধান কর্মকর্তা সৈয়দ নাভেদ হুসেইন এএফপিকে বলেন, আমরা ফেব্রুয়ারি মাসেই দেখলাম, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে পিপিইর চাহিদা বেড়ে গেছে। সে মোতাবেক পরিকল্পনা পরিবর্তন করে আমরা পিপিই প্রস্তুতির ওপর মনোনিবেশ করলাম।

জানা যায়, গত মে মাসে বেক্সিমকো গার্মেন্টস থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের (৫৫ কোটি টাকা) পিপিই রপ্তানি করা হয়েছে। তারা চলতি বছর আরো ২৫০ মিলিয়ন ডলারের (২১২ কোটি টাকা) নিরাপত্তা সরঞ্জাম সেখানে সরবরাহ করবে।

নাভেদ হুসেইন বলেন, বর্তমানে পিপিই তৈরির কার্যক্রমে আমাদের কারখানার ৬০ শতাংশ পোশাক শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছেন। 

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর অনেক পশ্চিমা কোম্পানি তাদের অর্ডার তুলে নেয়। এতে গার্মেন্টসগুলো অনেক শ্রমিককেই বেতন দিতে পারেনি। চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে। তাদের মধ্যেই দুইজন হলেন সুমাইয়া আকতার ও রুবেল মিয়া। তবে কারখানায় আবার কাজ শুরু হওয়ায় তারা চাকরি ফিরে পেয়েছেন।

সুমাইয়া আকতার বলেন, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। কারণ অনেকেই চাকরি হারিয়ে আর কোনো কাজ পায়নি। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে কাজ করা অনেক কঠিন। তবে পরিবারের মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে এই কাজ করতেই হবে।

জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ ৪ হাজার কোটি ডলার আয় করে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে। এর ৮০ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। কিন্তু এপ্রিলে ৪ হাজার ৫০০টি শিপমেন্ট আটকে যায় পশ্চিমা দেশে লকডাউন কার্যকর করার পর। বিজিএমইএ তথ্যমতে, ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর গার্মেন্টসগুলোর ৩২ লাখ ডলারের বিভিন্ন অর্ডার বাতিল হয়। চাকরি হারায় অনেক কর্মী। তবে বর্তমানে পিপিই ও অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জামের অর্ডারের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে গার্মেন্টস খাত। 

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র মুখপাত্র খান মনিরুল আলম শুভ বলেন, অর্ডারের পরিমাণ খুব কম। তবে এ কথা সত্য যে মার্চের তুলনায় এখন একটু বেড়েছে। যার ফলে রপ্তানি আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় ধীরে ধীরে কমে আসছে। আশা করছি পোশাক শিল্প আবারও এ দূরবস্থা কাটিয়ে উঠবে।

পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এ শিল্পের শ্রমিকদেরও আর্থিকভাবে স্বাভলম্বি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। করোনার প্রভাবে পোশাক শিল্পের সমস্যার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। অর্থ মন্ত্রণালয় যার জন্য একটি গাইডলাইন দিয়ে নির্দেশনা জারি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে তহবিলের অর্থ বিতরণ করবে, সেটি চূড়ান্ত করতে অর্থমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন গভর্নর ফজলে কবির। 

এছাড়া শতভাগ রপ্তানীমুখী শিল্প সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিল হতে ৮৪ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলের ১২তম বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, শ্রমিকদের সহায়তায় এ অর্থ প্রদান করা হবে। শ্রমঘন এ শিল্পের আর্থিক কল্যান সাধনে এ উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

আরকে//