করোনায় হার্ড ইমিউনিটি কি সুরক্ষা দেয়?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৩৮ পিএম, ১১ জুলাই ২০২০ শনিবার
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস ঠেকানোর কৌশল হিসেবে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে হার্ড ইমিউনিটি। আমাদের দেশেও করোনা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এটি নিয়ে বেশ কথাবার্তা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
হার্ড ইমিউনিটি বলতে, এক ধরণের কমিউনিটি ইমিউনিটিকে বুঝায়। অর্থাৎ, যখন সমাজের বড় একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে কোন সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি তৈরি হয়। এতে করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা তেমনটা নেই, তাদেরকেও ওই রোগ হতে পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয়া যায়।
এই পরোক্ষ সুরক্ষাই মূলত হার্ড ইমিউনিটি। যা হার্ড প্রটেকশন নামেও অভিহিত।
সম্প্রতি স্প্যানিশ এক গবেষণায় এ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এরপর থেকে দেশিয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও এটি নিয়ে বেশ চিন্তিত। বলা হচ্ছে এর কার্যকারণ উপকারের চেয়ে শঙ্কাই বেশি।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র পলিসি লিড ডা. শাহরিয়ার রোজেন এবং প্রকৌশলী ও পিএইচডি গবেষক মুহম্মাদ রহমান জাতীয় একটি দৈনিকে তাদের আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন।
তারা বলেন, ‘হার্ড ইমিউনিটি’র পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এখানে অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, মানুষের বিহেভিওরিয়াল ব্যাপারগুলো আলোচিত হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিই কিন্তু একেবারে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘জীবন’। এটি কেবল হতাশার কথা- তাই নয়, এর চেয়ে বড় উদ্বেগের আর কিছু এ মুহূর্তে হতে পারে না।’
তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই কি তাদের জীবন এত মূল্যহীন?
এই বিশেষজ্ঞের মতে, ‘সাধারণত একটি দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন সংক্রমিত হয়ে যায় তখন দেশটি হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছায়। তবে এ সংখ্যাটি একেবারে সম্পূর্ণ সত্য নয়। কোন মহামারি কতটা সংক্রামক তার ওপর নির্ভর করে এ সংখ্যাটিও কম-বেশি করতে পারে।’
হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে মূলত আমাদের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগকে (অথবা আরও বেশি) করোনায় আক্রান্ত হতে হবে। শুধু তাই নয়, যারা বেঁচে থাকবে তাদের পুরোপুরি করোনাপ্রতিরোধীও হয়ে উঠতে হবে। ব্যাপারটি একইসঙ্গে ফ্যান্টাসি এবং হরর-এর সংমিশ্রণ।
কারণ, আমাদের কাছে এখনও কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ নেই যেটি দাবি করে, একই মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারে না বরং একাধিকবার আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা দেখেছি এবং সেটি কেবল বৃদ্ধ-রুগ্ন মানুষের ক্ষেত্রে নয়- একেবারে সুঠাম কমবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
অন্যদিকে হরর বা ভয়াবহ কারণ হলো, আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ মানুষ বলতে কিন্তু বোঝায় একটি অবিশ্বাস্য ধরনের বড় সংখ্যা। যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং শতকরা ১ ভাগ মৃত্যুবরণ করে তবে সেই সংখ্যা কত ভয়াবহ হবে- সেটি আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে ভয়াবহতা আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়।
ডা. শাহরিয়ার রোজেন ও মুহম্মাদ রহমান বলেন, ‘ব্রিটেন প্রথমদিকে হার্ড ইমিউনিটির এ বিপজ্জনক কথা ভেবেছিল। তবে বিজ্ঞানী ফার্গুসনের মডেলে তাদের প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর প্রেডিকশন দেখে তাদের টনক নড়ে ওঠে এবং তারা এ ভয়ঙ্কর চিন্তা থেকে সরে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডা. মারিয়া ভ্যান কারকোভ তাই সরকারগুলোকে বারবার সাবধান করছেন অপেক্ষা করার জন্য। একটি কার্যকরি ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আমাদের এখনও দ্বিতীয় কিছু ভাবার সময় আসেনি।’
তাদের মতে, এতদিন লকডাউন করার পর এখন হার্ড ইমিউনিটির কথা বললে জনগণ বিভ্রান্ত হবে। পাশাপাশি যারা এতদিন সোশ্যাল ডিসটেন্সের নিয়ম মেনে চলছিল তারাও নিয়মের প্রতি উদাসীন হবে। তবে, হার্ড ইমিউনিটির কথা না বলে তারা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শগুলো হলো-
১. প্রতিদিন দেশে যে পরিমাণ করোনা টেস্ট করা হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। নমুনা টেস্টের হার বাড়াতে হবে।
২. আক্রান্ত ব্যক্তির টেস্ট পজিটিভ আসার আগে তার দ্বারা যারা সংক্রমিত হতে পারে তাদের চিহ্নিত করে তাদের জানাতে হবে এবং কোয়ারেন্টিন করতে হবে।
৩. গার্মেন্টস, শপিংমলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে সব কর্মচারীর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে।
৪. জনগণের মাঝে সামাজিক দূরত্ব এবং হাইজিন-এর (হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা) চর্চা করার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে তবে তাও হতে হবে নিয়ম মেনে।
৫. করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
এআই/এমবি