একজন রইস মিয়া ও তার মানবিকতা
সমর ইসলাম
প্রকাশিত : ০৪:২৬ পিএম, ১২ জুলাই ২০২০ রবিবার
নাম রইস মিয়া। না, সমাজের কোনো রইস ব্যক্তি নন তিনি। পেশায় দিনমজুর। বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচির গোপরেখী গ্রামে। একটু পাগলাটে টাইপের মানুষ। না হলে আজকালকার যুগে নিজের খেয়ে কেউ বনের মোষ তাড়ায়? তাড়ায় না। কিন্তু রইস মিয়া তাড়ান। আর তাই তিনি সাধারণের কাছে পাগলাটে। গ্রামের মানুষ তাকে ‘রইস পাগলা’ বলে ডাকে। রইস পাগলার পাগলামির একটা ঘটনা এখানে তুলে ধরছি।
কয়েক বছর আগের কথা। গোপরেখী গ্রামের ভেতর দিয়ে হুরাসাগর নদীর একটি খাল বয়ে গেছে। এই খাল গ্রামের দু’পাড়ের ৫ হাজারের বেশি মানুষের পারাপারের জন্য একটা দুর্ভোগ। কোনো সাঁকো-সেতু নেই। গ্রামের মানুষ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে অনেকবার ধর্না দিয়েও সাড়া পাননি। তাদের সঙ্গে ছিলেন রইস পাগলাও। ফলে দুর্ভোগ-দুর্দশার মধ্য দিয়েই খাল পারাপার করতে হয় তাদের।
সবাই হতোদ্যম, কিন্তু রইস পাগলা না। তিনি কারও কাছেই আর গেলেন না। কাউকে কিছু বললেনও না। সাঁকোর চিন্তা তার মাথা থেকে নামে না। কিন্তু উপায় কী? উপায়ান্তর না পেয়ে দিনমজুর রইস পাগলা নিজের গরু বিক্রি করে দিলেন। ঋণ নিলেন সমিতি থেকে। ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ করে বাঁশ আর কাঠ কিনে নির্মাণ করেন ৯২ হাত লম্বা সেতু। তারপর সুন্দর করে রঙ করলেন। গ্রামের মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখলো পাগলের কাণ্ড। এবার উদ্বোধনের পালা। কাকে দিয়ে উদ্বোধন করানো যায়? ভাবতে থাকেন রইস পাগলা। একবার ভাবেন জনপ্রতিনিধিদের ডাকবেন। পরক্ষণেই মনে হয়, ওরা মিথ্যাবাদী। এই সেতু নির্মাণের কথা বলে অনেকবার ভোট নিয়েছে জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। তাহলে কি প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকে প্রধান অতিথি করবেন? না, তাও হবে না। কারণ, গ্রামবাসীর সাথে নিয়ে ওদের কাছে অনেকবার গিয়েছে রইস পাগলা। কিন্তু সমাধান হয়নি।
এবার নিজের মনকে দৃঢ় করেন রইস পাগলা। শান্তমনে সিদ্ধান্ত নেন, এই সেতু কোনো নামী-দামী মানুষকে দিয়ে উদ্বোধন করাবেন না। করাবেন ফকির মিসকিনকে দিয়ে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। তিনি খুঁজে বের করেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী দুই বৃদ্ধাকে। যারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জমান। তাদেরকেই দাওয়াত দেয়া হয়। যৌথভাবে করা হয় সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। গ্রামবাসীকেও দাওয়াত দেয়া হয়। সেতুর দুই পাড় সাজানো হয় নানা রঙের কাগজ দিয়ে রঙিন সাজে। একটা উৎসব উৎসব আমেজ তৈরি হয়।
মানুষ দেখলো এক ব্যতিক্রমী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বৃদ্ধা আছিয়া ও হাফিজা খাতুন। প্রধান অতিথি হিসেবে তাদের নাম ঘোষণা করলে চমকিত হন গ্রামের মানুষ। তবে বরণও করে নেন। একটা চাপা গুঞ্জন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দুই বৃদ্ধা ফিতা কেটে সাঁকোটি উদ্বোধনের পর সবার চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে দেশের মোঙ্গল কামনায় মোনাজাত করা হয়। গ্রামের মানুষ রইস পাগলাকে মাথায় তুলে নাচানাচি শুরু করে। আনন্দে রইস পাগলার চোখে পানি এসে যায়। নিজের রুটিরুজির চিন্তা না করে যিনি গরু বিক্রি ও ঋণ করে মানুষের উপকারের কথা ভেবে সেতু নির্মাণ করে দেন, তিনি তো আর যেই সেই পাগল নন। এমন কয়টা রইস পাগলা আছে আমাদের সমাজে?
দুই.
ওপরের ঘটনাটি একুশের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি চারণ সাংবাদিক স্বপন মির্জা সে সময় খবর করে পাঠান। আমার কণ্ঠে সেটি সম্প্রচারিত হয়। গ্রামের মানুষের সাথে এমন জনহিতকর কাজের খবর জানতে পারেন দেশের মানুষ এবং বিদেশে থাকা বাংলা ভাষাভাষীরা। টনক নড়ে প্রশাসনের। ক’দিন পরই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল হাসান পরিদর্শন করেন ঘটনাস্থল। তারপর? তারপর, ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্থায়ী পাকা সেতু। সেই সেতু এখন খালের দুই পাড়ের বাসিন্দাদের বন্ধন আরও মজবুত করেছে। গ্রামের মানুষ, মালামাল, স্কুলের শিক্ষার্থী- সবাই পার হন সেতু দিয়ে। রইস পাগলার এই পাগলামির ফসল ভোগ করছে এখন গ্রামবাসী। রইস মিয়ার জন্য অনেক শুভ কামনা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নিউজরুম এডিটর, একুশে টেলিভিশন, ঢাকা।
এনএস/