করোনাকাল: নিতে হবে নিজস্ব প্রস্তুতি
ডা. হাসনাইন নান্না
প্রকাশিত : ০৭:৩৮ পিএম, ১২ জুলাই ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৭:৩৯ পিএম, ১২ জুলাই ২০২০ রবিবার
ডা. হাসনাইন নান্না
করোনা ভাইরাসের টিকা বা কার্যকর কোন ওষুধ সহসাই আবিষ্কার হবে কিনা হলফ করে বলা মুশকিল। হলেও তা আমাদের মতো দেশে দ্রুত আসবে কিনা তাও অনিশ্চিত। কেননা, টিকার ভেতর অবধারিতভাবে থাকবে অর্থনীতি ও রাজনীতির কঠিন ও কুটিল থাবা। টিকা বা ওষুধ এদেশে আসলেও অধিকাংশ মানুষের নাগালের মধ্যে পৌঁছাবে কিনা আগে ভাগেই বলা কঠিন। কারণ যাদের মৃত্যুভয় বেশি, যাদের অঢেল সম্পদ আছে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবারের জন্য মাথাপিছু শ’খানেক টিকা বা ওষুধ রেখে তারপর হয়তো দয়াকরে দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করবেন।
কথাটি হয়তো বিত্তশালীদের শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এই দুর্যোগ পরিস্থিতির একদম শুরুতে আমরা দেখেছি, কিভাবে ধনবানরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে বাসার মধ্যে গুদামজাত করেছেন। তারা তখন ভাবেননি, এই লাগাম ছাড়া কেনাকাটার মাধ্যমে যে কৃত্রিম সংকট তারা তৈরি করলেন, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষকেই। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষরাই খাদ্য সংকটে পড়েছেন। কাজেই টিকা আসলেও যে তা নিম্ন আয়ের মানুষরা সহজেই পেয়ে যাবেন বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনা আয়াসে আয়ত্ত করবেন –এমন ভাবনা মুলতুবি রাখাই আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ।
তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আরও অনেক দিন (হয়তো বাকি জীবনই) করোনার সাথে বসবাসের প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন বসবাস আমরা করছি সর্দি, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জার সাথে। ইকোনমিস্টের গত ৪ জুলাই সংখ্যায় এমআইটির এক গবেষণা প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ২০২১ সালের মাঝামাঝি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৩৫-৬০ কোটি মানুষে! আরো বেশি হতে পারে। বা কমও হতে পারে। এর মাঝে যে টিকা বা ওষুধ বের হবেই এমন কোন জোরালো আলামত নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত করোনার কোনো কার্যকর ওষুধ না বেরোচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নির্ভর করতে হবে করোনা মোকাবেলার নিজস্ব প্রস্তুতির ওপর।
করোনা ভাইরাসের কারণে ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রাথমিক মৃত্যুর যে হার এর মূল কারণ ছিল আতঙ্ক। আর তার পরের কারণ হচ্ছে, তাদের সমাজ ব্যবস্থার অমানবিকতা। স্পেন এবং ইটালিতে ওল্ড এজ হোমের সেই বয়স্ক মানুষগুলোকে জেনেশুনেই সমস্ত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। নির্দেশনা ছিল যে, এদের চিকিৎসার চেষ্টা করার প্রয়োজন নাই। স্পেনে এ অমানবিক নির্দেশনাই বয়স্কদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। যুক্তরাষ্ট্রেও আতঙ্কের কারণে সেখানে দিনে তিন হাজার মানুষও মারা গেছে! আর এখন আতঙ্ক কমে আসায় দিনে গড় মৃত্যুর সংখ্যা হাজারের নিচে।
একজন মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে- তার দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা তার ইমিউন সিস্টেম। আর ইমিউন সিস্টেমের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে- আতঙ্ক। যখন মানুষ আতঙ্কিত হয় বা ভয় পেয়ে যায়, তখন তার ইমিউন সিস্টেম অকার্যকর হয়ে যায়। এবং করোনা সংক্রান্ত প্রাথমিক যে মৃত্যু সেটার প্রধান কারণ ছিল করোনা আতঙ্ক। যদিও করোনাকে যেভাবে প্রাণঘাতী বলা হচ্ছে, করোনা সেইরকম প্রাণঘাতী মহামারি নয়। মৃত্যুর হার, সুস্থতার হার ও আক্রান্তের হার দেখলেই আমাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
সবদিক মিলিয়েই এখন করোনা মোকাবেলার দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। যেখানে সেখানে থুতু ফেলার প্রাচীন বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এখনও রাস্তা ঘাটে দেখা যায়, মানুষ মাস্ক খুলে খোলা বাতাসে আরাম করে হাঁচি দিচ্ছে, তারপর আবার মাস্ক পরে নিচ্ছে। নাক ঝাড়ছে যেখানে সেখানে। হাঁচি-কাশির সময় রুমাল, টিস্যু ব্যবহার করা সব সময়েরই শিষ্টাচার। এই শিষ্টাচার পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো পালনের বিষয়ে আন্তরিক নই। পাশাপাশি, সর্দি-কাশির জন্যে স্বাভাবিক প্রতিষেধক ভাপ নেওয়া আর গরম পানি দিয়ে গার্গল- এসব করতে হবে।
এখন ইউরোপের ডাক্তাররাই বলছেন, তাদের গবেষণা রিপোর্টই বলছে- এই লবণ পানি গার্গল সর্দি-কাশিতে যে রকম কার্যকর; করোনার ক্ষেত্রেও একইভাবে কার্যকর। কালিজিরা, মধু, রসুন -এসব নিয়মিত খাওয়া খুবই উপকারী, নিজের ভেতর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। দেহের যত্ন নেয়া, পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম ইত্যাদি নিয়মিত করলে খুব সফলভাবেই আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব।
শেষ করার আগে ছোট্ট একটি বিষয় তুলে ধরি। যারা এখনো ঘরের মধ্যে আতঙ্কিত জীবন কাটাচ্ছেন; তাদের জন্য আতঙ্কমুক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি এখন। যারা এসি রুমে থাকেন প্রত্যেকদিন দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয়া উচিত। বাইরের বাতাস, গরম বাতাস ঢোকার সুযোগ দেয়া দরকার। কারণ ঠান্ডা আবহাওয়া, ঠান্ডা বাতাস করোনার জীবাণুকে দীর্ঘক্ষণ জীবিত রাখতে পারে। করোনার ওপরে যেহেতু চর্বির একটা প্রলেপ আছে, এই প্রলেপের জন্যে সবচেয়ে বেশি উপযোগী হচ্ছে ঠান্ডা আবহাওয়া। অতএব এসি রুমের মধ্যে আটকে না থেকে দরজা-জানালা খুলে বাইরের মুক্ত ও গরম বাতাস ঢোকানোর ব্যবস্থা উত্তম। একটু রোদ লাগানো উত্তম। প্রখর রোদ আরো ভালো।
(লেখক- হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জ।)
এনএস/