তিন শতাব্দির সাক্ষী এন্তেজ আলী মাতুববর
বাউফল (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা
প্রকাশিত : ০৩:৪৮ পিএম, ১৪ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার
মো. এন্তেজ আলী মাতুববর
বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী। বেঁচে নেই তার বন্ধু-বান্ধবদের কেউ। বছর খানেক আগেও মনের জোর আর দীর্ঘদেহী সুঠাম শক্ত সামর্থ্য থাকলেও এখন শরীর-স্বাস্থ্য তেমন ভাল যাচ্ছে না তার। কানে শুনছেন না ঠিকঠাক। কমেছে চোখের আলো আর স্মৃতি শক্তিও। তবে বেঁচে আছেন তিন শতকের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে পটুয়াখালীর বাউফলের তেঁতুলিয়া নদীর কুলঘেসা ধানদী গ্রামের এই এন্তেজ আলী মাতুববর।
পরিবারের লোকজন জানায়, মো. এন্তেজ আলী মাতুববরের জন্ম ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে। তার বাবার নাম মৃত. মেছের আলী মাতুববর। মায়ের নাম মোসা. বিবিজান। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সাল গণনায় তিন শতকের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি।
জাতীয় পরিচয় পত্রে তার জন্ম তারিখ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৫ সন লেখা হয়েছে। তবে নির্বাচনের সময় ভোটার তালিকা করতে এসে অনুমান করে এই তারিখ দেওয়া হলেও তার ও পরিবারের লোকজনের হিসেব মতে প্রকৃত পক্ষে ১৯ শতকেই জন্ম তার। ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে পরিচয় পত্র সংশোধনের চেষ্টা করা হয়নি কখনো।
বিংশ শতাব্দি পার করে একুশ শতকে এসে তিন শতকের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছেন তিনি। পরিচয় পত্র অনুযায়ী বয়স (১৫ জুলাই, ২০২০ তারিখে) ১১৫ বছর ৫ মাস ১৪ দিন। জানা মতে আশপাশ ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ।
এন্তেজ আলী মাতুববর চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক। বড় ছেলে নুরুল ইসলামের বয়স ৬৬ বছর। ছেলেদের মধ্যে দ্বিতীয় সামসুল হক ও বড় মেয়ে ফেরেজা বেগম মারা গেছেন। নাতী-নাতনী রয়েছে ৬১ জন। বছর দুইয়েক আগেও লাঠিতে ভর করে ছোটখাট নিজস্ব কাজ-কাম করতে পারতেন। স্বাভাবিক কানে শুনতেন। সবকিছু স্পষ্ট দেখতেন চোখেও। কিন্তু বয়সের ভারে দিন দিন কাবু হয়ে এখন বিছানায় শুয়ে কাটে তার সময়। স্ত্রীকে হারিয়েছেন ১৯১১ সালে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে উপজেলার মদনপুর গ্রামের সিকদার বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, তেঁতুলিয়া নদীতে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে টাইম বোমা নিক্ষেপ, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে পানিতে ভেসে যাওয়া তার নাতী-নাতনীসহ বড় মেয়ে ফেরেজা বেগম ও ছেলে সামসুল হকের খোঁজে পরদিন সাগর ঘেষা চরবিশ্বাস এলাকায় গিয়ে দেখা বন্যায় লন্ডভন্ড বিভৎস সব দৃশ্যের কথা মনে আছে তার।
মনে আছে ওই বন্যার পর বড় গোফের মানুষ মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী ও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কালাইয়া বন্দরের ধানের হাট এলাকায় পদার্পণের কথাও। মনে আছে তার ওই আমলের ঐতিহাসিক স্থান রাজধানী খ্যাত কঁচুয়ার ধ্বংসাবশেষ, আবে-আব্দুল্লাহর গঞ্জ, শোলাবুনিয়ার দীঘি, ভাওয়াল রাজার বংশদ্ভোদ কমলা রাণীর দীঘির স্মৃতিকথা।
গদ গদ করে শুনিয়েছেন তিনি এসব গল্প পরিবারের অনেককেই। তবে দিন দিন শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ছেন তিনি। দেড়-দুই বছর আগেও বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী আর দারুণ আত্মবিশ্বসী থাকলেও এখন আর স্মৃতিশক্তি নেই আগের মতো। এক নজর দেখতে আসা প্রতিবেশী কাউকে পরিচয় করিয়ে দিলে তাৎক্ষণিক চিনতে পারলেও খানেক পরেই আবার তাকে ভুলেও যান তিনি। আগের মতো খাবারদাবার কিংবা প্রাকৃতিক কর্মগুলো চলে না পরিবারের লোকজনের সাহায্য ছাড়া।
এন্তেজ আলী মাতুববরের ছোট ছেলে মো. মঞ্জুর আলম জানান, ‘প্রায় ৬ ফুট লম্বা তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়। বেঁচে নেই তার বড় বোন। পাশের গ্রাম ছোট ডালিমায় স্বামী সংসারে আছেন ছোট বোন সোমর্ত বানু।’
তিনি বলেন, ‘বাবা মসজিদ-মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আজীবন জড়িত ছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে স্থানীয় ধানাদী ফাজিল মাদ্রাসায় এক একর জমি দান করেছেন। পড়াশুনা প্রাইমারি পর্যন্ত। কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকতে ওই সময় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি হিসেবে চাকরিও করেছেন মাদ্রাসায়। স্বীকৃতি দিয়ে বয়স্ক মানুষের তালিকায় তার বাবা এন্তেজ আলী মাতবরের নাম ওঠানো তাদের জন্য গর্বের কোন বিষয় নয়। পরিচয় পত্রে অনুমান নির্ভর বয়স লেখা হয়েছে তার। আসলে ঊনবিংশ শতাব্দিতে জন্ম তার। তিন শতাব্দির সাক্ষী হবেন তিনি।’
মঞ্জুর আলম বলেন, ‘বাবা নিয়মিত পরিশ্রম করতেন। জীবনে কোন দিন ধুমপান করেননি। আগে ঢেঁকিছাটা চালের ভাত, দুধ, ডিম, মাছ, কলা ও নির্ভেজাল ফলমূল, শাক সবজিসহ পুষ্টিকর খাবার খেতেন নিয়মিত। কেবল ডাল-ভাতেও অনিহা ছিল না তার। এলাকায় মাইক কিংবা লাউড স্পিকারের মতো শব্দযন্ত্রের হরহামেশা ব্যাবহারের আগে তার উচ্চস্বরের আযানের ধ্বনিতে আশপাশের এলাকাসহ স্থানীয় লোকজন সকালের ঘুম ভেঙে ফজরের নামাজের জন্য উঠতো। লোকমুখে এখনও শোনা যায় এক সময় তার কন্ঠের আযানের শব্দেই ভোর বেলায় নদীর ওপাড়ের চাষিরাও সকাল হয়েছে ভেবে ক্ষেতে লাঙল-জোয়ালের হাল নিয়ে রওনা হতো।’
বাবা এন্তেজ আলী মাতুববরের জন্য এই মহামারি করোনাকালে স্থানীয় শুভাকাঙ্খিসহ সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।
প্রতিবেশীরা জানান, ‘আশপাশের দুই-চার এলাকায় এন্তেজ আলী মাতবরের মতো বয়স্ক লোকের কথা জানা যায় না। এই আধুনিক যুগে ফরেনসিক পরীক্ষা করে সঠিক বয়স প্রমাণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ তাকে স্বীকৃতি দেওয়া।’
স্থানীয় ইউপির মেম্বর আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘আমার জানামতে এই এলাকায় এন্তেজ আলী মাতুববরের মতো বয়স্ক মানুষ আর নেই।’
এআই/এমবি