‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:৫৩ পিএম, ১৭ জুলাই ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:১৪ পিএম, ১৭ জুলাই ২০২০ শুক্রবার
মহামারি করোনা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আপনজনকে। আক্রান্ত রোগী থেকে মৃতব্যাক্তি, ধনী থেকে দরিদ্র, শিল্পপতি থেকে শীর্ষ নেতা কারও পাশেই দেখা মিলছে না স্বজনদের। স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা থেকে বন্ধু-স্বজন সবাই দূরত্ব বজায় রাখছেন। শেষবারের মতো মৃতের মুখটাও দেখতে চায় না অনেকে। এলাকাবাসী বা স্বজনরা সহযোগিতা তো দূরের কথা, বিদায় হওয়া মানুষটির জানাযা বা দাফনে অংশ নিতেও নারাজ তারা। এমনকি কোন কোন এলাকায় করোনায় মৃতব্যাক্তির লাশটাও প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। এ যেনো ভিন্ন এক জগতের নব রূপ দেখছি আমরা।
সম্প্রতি এক শিল্পপতির মৃত্যুর পর নিজে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে একজন বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। যা প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
ওই সাংবাদিক জানান, শিল্পপতি যখন আইসিইউতে, ঘটনাক্রমে তিনিও কয়েকদিন তার পাশের রুমটাতে ছিলেন। এ সময়ে তিনি দেখেছেন শিল্পপতির আত্মীয় স্বজন কেউই খোঁজ নিতে আসেননি। মৃত্যুর সময়ে একজন প্রিয় মানুষেরও হাতের স্পর্শ তিনি (শিল্পপতি) পাননি! কারো সাথে বিদায় শব্দটি বলতে পেরেননি। ভীষণ নি:স্তব্দ একটি রুম, আধো আলো, আধো ছায়া, চারপাশে সব অর্ধমৃত, মৃতপ্রায় মানুষ। সেখানেই তিনি একা ছিলেন। সেখানেই বিদায় নিয়েছেন মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে। আহারে জীবন!
ঠিক এমনই আরেক ঘটনার বর্ণনা দেন করোনায় মৃতদেহ দাফনে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবীদের এক সদস্য। তিনি জানান, মধ্যবয়সী এক মা মারা গেছেন কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুবরণ করেছেন রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। মৃত্যুর পর তার লাশ রাখা ছিল সেই হাসপাতালের মর্গে। হাসপাতালে ছিলেন শুধু ওই নারীর এক ছেলে। তিনি অপেক্ষা করছিলেন কখন হাসপাতালে লাশ দাফনকারী স্বেচ্ছাসেবীরা পৌঁছাবে এবং লাশ নিয়ে যাবে সে জন্য।
স্বেচ্ছাসেবীরা হাসপাতাল পৌঁছার পর দেখলেন, মৃত নারীর যুবক ছেলেটি পিপিই পরে আছেন। সেটা দেখে তারা ছেলেটিকে অনুরোধ করলেন শেষ পর্যন্ত থাকতে। কিন্তু ছেলেটি মর্গে তার মায়ের লাশের নম্বর এবং নামটা বলেই চলে গেলেন। স্বেচ্ছাসেবীরা লাশ খুঁজে পেয়েছেন কিনা সেটি দেখার জন্যেও অপেক্ষা করেন নি তিনি।
এদিকে স্বেচ্ছাসেবীরা মর্গের নির্দিষ্ট ড্রয়ারে তার মায়ের নামের ট্যাগসহ কোনো লাশ খুঁজে পাচ্ছেন না। একটার পর একটা ড্রয়ার তারা খুলছেন, কিন্তু সেই মায়ের নামে কোনো লাশ আর মেলে না। বেশ অনেকক্ষণ চেষ্টার পর অন্য একটি ড্রয়ারে লাশের খোঁজ মিলল। খুব ছোট করে লেখা ছিল সেই মায়ের নাম।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মর্গে তখন এত লাশ ছিল যে, ড্রয়ার ছাড়াও মেঝেতে অনেক লাশ পড়ে ছিল। ভদ্রমহিলার লাশ পরিচ্ছন্ন করার জন্যে নিচে নামানোর মতো জায়গা অবশিষ্ট নেই। তখন হাসপাতালের একজন কর্মচারী এলেন। তিনি কয়েকটা লাশ সরিয়ে একটু জায়গা বের করে দিয়েই মুহুর্তের মধ্যে চলে গেলেন। এরপর তার দেখাও মেলে নি আর।
মৃতদেহের হাতে ইনজেকশনের ক্যানুলা এবং প্রস্রাবের ক্যাথেটার কিছুই খোলা হয় নি তখন পর্যন্ত! আশেপাশেও কেউ ছিল না এ-কাজে সহযোগিতা করার মতো। চারিদিকে লাশ পরিবেষ্টিত সেই মর্গে তখন খুব অসহায় বোধ করছিলেন মহিলা স্বেচ্ছাসেবীরা। আর ফেস শিল্ড পরে চোখেও ঝাপসা দেখছিলেন তারা। বাধ্য হয়ে অনভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবীরাই ক্যানুলা খুললেন। আর ক্যাথেটার খুলতে না জানার কারণে সেটা খোলার সময় ইউরিনে মেঝে ভেসে একাকার। দাফন টিমের মহিলা সদস্যরা অনেক কষ্টে সেই মৃতদেহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। জীবাণুমুক্ত করে লাশ প্যাকেট করে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে আসেন।
তারপর স্বেচ্ছাসেবী দলের পুরুষ সদস্যদের সহযোগিতায় লাশ দাফন করা হয় রাজধানীর নির্ধারিত কবরস্থানে। নির্জন কবরস্থান। মধ্য দুপুরে প্রচণ্ড রোদ। কোথাও কেউ নেই। সেখানে মৃত মায়ের জন্যে নামাজে জানাজা পড়ান স্বেচ্ছাসেবীরাই। তারা নিজের মায়ের মমতায় দোয়া করলেন মৃতের জন্যে, যার শেষ বিদায়ে ছিল না কোনো আপনজন।
এমনই আরেক ঘটনায় জানা যায়, দুই সন্তানের জননী। ১৯ জুন ২০২০ সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ শহরের একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করে স্বেচ্ছাসেবীদের টিমকে।
তারা রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে এক শীর্ণকায় নারীর দেহ। তার রক্তশূন্য জীর্ণ অবস্থা দেখেই চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন হয় স্বেচ্ছাসেবীদের। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন ভগ্নস্বাস্থ্যের অসহায় এই নারী।
হাসপাতাল থেকে নম্বর জোগাড় করে মৃতের আপনজনদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কোনো সহযোগিতা তারা করবেন নাকি বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটা দাফন করা হবে, এ সিদ্ধান্তের জন্যে মূলত ফোন করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর মরহুমার স্বামী এবং ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো। তারা প্রথমে বললেন, লাশ নিতে হাসপাতাল আসছেন। কিন্তু মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্ব তারা পরবর্তী তিন-চার ঘণ্টায়ও অতিক্রম করতে পারেন নি। বার বার ফোন করা হচ্ছে। বার বার তাদের একই কথা—এই তো চলে আসছি, এখনই আসছি।
তিন-চার ঘণ্টা পরে তারা জানালেন, করোনাভাইরাসের কারণে গ্রামে লাশ নিতে আপত্তি জানাচ্ছে গ্রামবাসী। তখন তাদেরকে জানানো হলো প্রশাসন থেকে সহায়তা দেয়া হবে। ইতোমধ্যে যে-কোনোভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মৃত মহিলার খবর জেনেছেন। তারাও যোগাযোগ করেছেন স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে। এরকম পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবীদের পক্ষে লাশের দাফন বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের তখন কিছুই করার ছিল না।
অপেক্ষা করতে করতে রাত ১২টা। লাশ পড়ে আছে হাসপাতালের মর্গে। এসময় মরহুমার স্বামী এবং ভাই হাসপাতালে এলেন। কিন্তু তারা লাশ গ্রহণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত দিলেন। তখন তো স্বেচ্ছাসেবীদের মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কারণ বেওয়ারিশ লাশের জন্যে আলাদা আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, যা এত রাতে আর সম্ভব নয়। তখন বাধ্য হয়ে লাশ হাসপাতালের মর্গে রেখেই তারা ফিরে গেলেন।
স্বেচ্ছাসেবীরা মৃতের ভাইকে কিছু প্রশ্ন করে জানতে পারলেন, মৃত্যুর চার মাস পূর্বে দ্বিতীয় বারের মতো মা হন এই নারী। এরপর থেকেই তিনি নানারকম শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকেন। এসময় স্বামী তাকে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এ চার মাস ধরে নিয়মিত রক্তক্ষরণ হতো এবং তীব্র ব্যথা ছিল তার। কিন্তু তেমন কোনো চিকিৎসা তিনি পান নি। অবস্থার আরো অবনতি ঘটে যখন তিনি করোনা আক্রান্ত হন। তখন তার স্বামী তাকে হাসপাতাল ভর্তি করে চলে যান।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর তিন দিন আগে থেকেই তার কোনো খোঁজখবর নেন নি তার স্বামী, ভাই কিংবা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য।
পরদিন সকালে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে ফোন আসে, বেওয়ারিশ হিসেবেই মহিলার লাশ দাফনের জন্যে। সিদ্ধান্ত পেয়ে হাসপাতাল পৌঁছে পুরোদমে কাজ শুরু করেন তারা। লাশ প্রস্তুত করতে গিয়ে মহিলা স্বেচ্ছাসেবীরা দেখলেন, লাশের চুলে কানে গলায় পেচানো অবস্থায় অনেকগুলো তাবিজ-কবচ। পরম প্রভুই ভালো জানেন, হয়তো-বা এসব তাবিজ-কবচকে আধুনিক চিকিৎসার বিকল্প হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে! তাবিজগুলো কেটে আলাদা করতেই অনেক সময় লেগে যায় স্বেচ্ছাসেবীদের।
এতকিছুর পর লাশ প্রস্তুত করে শহরের একটি কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। যাওয়ার পর দেখা গেল কবর বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে। পানি সেচতে হবে। এসময় আবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফোন এলো। জানানো হলো, এই নারীর ভাই তার বোনের লাশ গ্রামে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবীরা যেন আরেকটু কষ্ট করে লাশটি তাদের গ্রামে দাফন করেন।
তখন আবারো লাশ বয়ে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো, যদিও প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের মধ্যে পিপিই পরে থাকার কারণে শারীরিকভাবে কষ্ট হচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের। এই অবস্থায় আরো ৩০ মিনিটের পথ অতিক্রম করে গ্রামে নিয়ে যাওয়া সত্যিই কষ্টসাধ্য কাজ। তবুও তাদের অনুরোধে গ্রামে নিয়ে যান স্বেচ্ছাসেবীরা। সেখানে জানাজা শেষে এক পশলা বৃষ্টি। সবশেষে ২২ ঘণ্টা পর তার লাশ দাফন করা হলো।
এরকম শত শত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে মহামারি করোনা। যেখানে মমতা, মানবতা, আত্মিকবন্ধন সবই উপেক্ষিত হচ্ছে। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’।
এসএ/