যে দেশে নারীদের নাম প্রকাশ করা নিষেধ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৪৩ পিএম, ১৮ জুলাই ২০২০ শনিবার
বর্তমান এই আধুনিক যুগে কোনও মানুষের নাম প্রকাশ করা যাবে না এটা কল্পনার বাইরে। তবে পৃথিবীতে এমনও দেশ রয়েছে, যেখানে অপরিচিত মানুষের কাছে মেয়েদের নাম বলা নিষেধ! আফগানিস্তানের সমাজে এটাই চলছে। ‘বাইরের অপরিচিত’ মানুষের কাছে মেয়েরা তাদের নাম গোপন রাখতে বাধ্য হন পরিবারের চাপে। এমনকি ডাক্তারের কাছেও নাম বলা যাবে না।
আফগানিস্তানের এক নারী অনেক জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম লিখতে গিয়ে তার নাম জেনে নিয়ে লিখলেন। সেই প্রেসক্রিপশন স্বামী দিলেন ওষুধ আনতে। তা দেখেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন স্বামী। বাইরের ‘একজন অপরিচিত পুরুষের কাছে’ নাম প্রকাশ করার জন্য ওই নারীকে পেটাতে লাগলেন স্বামী!
সমস্যাটির শুরু একজন কন্যা সন্তানের জন্মের সময় থেকেই। বহু বছর পর্যন্ত তার কোন নামই থাকে না। তাকে নাম দিতেই গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। একটি মেয়ের যখন বিয়ে হয়, তখন বিয়ের আমন্ত্রণপত্রে কোথাও তার নাম উল্লেখ করা হয় না। সে অসুস্থ হলে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনেও প্রায়শই তার নাম উল্লেখ করা হয় না। সে যখন মারা যায়, তখন তার মৃত্যু সনদেও তার নাম লেখা হয় না। এমনকি কবরের স্মৃতিফলকেও সে নামহীনই থেকে যায়।
এই কথাগুলো অবাক করার মতই, কিন্তু এটাই আফগানিস্তানে নারীদের স্বাভাবিক চিত্র। মেয়েরা তাদের নিজেদের নাম ব্যবহার করলে সমাজ তাকে ভ্রূকুটি করে। এমনকি আফগানিস্তানের অনেক জায়গায় মেয়েদের নাম ব্যবহার করাকে পরিবারের জন্য অপমানজনক মনে করা হয়।
বহু আফগান পুরুষ তাদের বোন, স্ত্রী বা মায়ের নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেন না। কারণ বাইরে তাদের নাম বলা লজ্জার এবং অসম্মানজনক মনে করেন। নারীদের সাধারণত পরিচয় দেয়া হয় পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষের সাথে তার সম্পর্কের সূত্র ধরে। যেমন- অমুকের মা, অমুকের বোন বা অমুকের মেয়ে।
আফগান আইন অনুযায়ী শিশুর জন্ম সনদে শুধু বাবার নাম নথিভূক্ত করার বিধান আছে। এতে ব্যবহারিক কারণে নানা সমস্যা তো হয়ই, পাশাপাশি মানসিক দিক দিয়ে এর একটা প্রভাব থাকে।
সে কারণেই আন্দোলনে নেমেছেন কিছু নারী। তারা চাইছেন তাদের নাম প্রকাশের স্বাধীনতা। তাদের আন্দোলনের নাম তারা দিয়েছেন “হোয়্যারইজমাইনেম?” - আমার নাম কোথায়? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পোস্টারে এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন আন্দোলনকারী নারীরা।
কেউ কেউ এই আন্দোলন নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন, কেউ মস্করাও করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, পরিবারের মধ্যে শান্তি বজায় রাখাটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
তবে আফগানিস্তানের তারকা ও বিশিষ্ট কিছু মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক ফারহাদ দারিয়া এবং সঙ্গীত রচয়িতা আরিয়ানা সাঈদ প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পক্ষে আছেন।
“আফগানিস্তানের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের পরিচিতিকে স্বীকৃতি না দেবার প্রধান কারণ হল, পুরুষরা তাদের ‘সম্মান রক্ষায়’ নারীদের সারা শরীর ঢেকে রাখতেই শুধু বাধ্য করেন না, তারা চান মেয়েদের নামও ঢেকে রাখতে” বলছেন আফগান সমাজবিজ্ঞানী আলী কাভে।
আফগান চিকিৎসক শাকারদক্ত জাফারী মনে করেন, ‘আফগান নারীকে তার নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরতে হলে তার আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক স্বাধীনতারও প্রয়োজন। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সফল হওয়া কঠিন, সেখানে এই বৈষম্য দূর করতে হলে সরকারেই এগিয়ে আসতে হবে।’
নারীদের নাম প্রকাশের অধিকারের বিষয়টি ইতিমধ্যে আফগান সংসদে উঠেছে। মারিয়াম সামা সংসদে এই আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু ‘হোয়্যারইজমাইনেম?’ নামের এই আন্দোলন নিয়ে রাজনীতিকরা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তার ওপরই নির্ভর করবে এই আন্দোলনের ভবিষ্যত।
সূত্র: বিবিসি
এএইচ/