ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

রেনেসাঁ’র দেশে (দ্বিতীয় পর্ব)

শামীম আরা খানম

প্রকাশিত : ০৫:১৫ এএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৫:১৫ এএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার

আমার কর্তাব্যক্তিটি খুব পড়ুয়া। অনেক বই পড়েন। কোথাও বেড়াতে গেলে সেই দেশ সম্পর্কে আগে নিজে সব জেনে নেন তারপর ওখানে গিয়ে সবার আগে ওই দেশের দর্শনীয় ও কৃষ্টি ঐতিহ্য সম্বলিত বই কিনেন। বিখ্যাত ও দর্শনীয় স্থানগুলো আগে নিজে যাচাই বাছাই করে ভ্রমণের সময় ঠিক করেন। ইতালি যাবার আগেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। এ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলাম উনার কাছেই। উনি যে খুব ভালো একজন ভ্রমণসঙ্গী সেটা যারা তার সাথে ভ্রমণ করেছেন তাদের অনেকেই জানেন।

ইতালির বিখ্যাত ফিরাঞ্জে প্রদেশের (ফ্লোরেন্স) একটি শহর তাসকান (তুসকানা) বিফ স্টেক এর জন্য পৃথিবীখ্যাত। পেরুজ্জিয়া শহর দেখা শেষ করে আমরা সবাই বিখ্যাত সেই স্টেক এর স্বাদ চোখে দেখতে তাসকান শহরে যাব বলে মনস্থির করেছি। এরই মাঝে উনি জানালেন প্রথমে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্মস্থান আর তার সেই বিখ্যাত ছবি ‘মোনালিসা’ আঁকার ওই জায়গা ঘুরে তবেই স্টেক এর স্বাদ পেতে পারি। কী আর করা! এতদূর এসেছি আর এই দুটো দেখে যাব না তাই কী হয়? আমাদের গাইড ছিল আমার দেবর রহিম। অনেক বছর ধরে ইতালির আরেজ্জো শহরে থাকে। হোয়াইট গোল্ড এর ব্যবসা করে। খুব ভালো গাড়ি চালায়। ওরই বড় একটা হাইএস গাড়িতে আমরা সবাই মিলে চলে এলাম তুসকান এর পাহাড়ি এলাকা ভিঞ্চি গ্রামে।


লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জন্মস্থানে পরিবারসহ লেখক, জুন ২০১২

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৪৫২ সালে এই তুসকান এর আর্নো নদীর তীরে ভাটি অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বিখ্যাত চিত্র ‘মোনালিসা’এঁকে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন। তার আরও ছবি বিখ্যাত হয়েছিল ‘দা লাস্ট সাপার’ যেটা বর্তমানে ভ্যাটিকান শহরের মিউজিয়াম এ রক্ষিত আছে। লিওনার্দো ছোটবেলার প্রথম পাঁচ বছর কাটিয়েছিলেন আনসিয়ানোর একটি ছোট গ্রামে তারপর ফ্রান্সিসকো তে।

আমার কর্তা তো ঘুরে ঘুরে মুগ্ধ চোখে সেই নদী, ব্রীজ, রেললাইন, গোশালা, ধান, গম যব ভাঙানোর আদিযুগের ম্যানুয়াল মেশিন সব এমনভাবে দেখছিলেন যেন নিজে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলেন শিল্পীকে। ইতালীয়রা আদি আমলের সব ঐতিহাসিক স্থান আর স্থাপনাগুলোকে এমনভাবে সুরক্ষিত রাখে যে মনে হয় এগুলো নতুন! পুরোনো একটা দেয়াল ভেঙে গেলে ওরা নতুন করে বানায় কিন্তু স্টাইল সেই একই পুরোনো। ওখানকার মানুষ খুবই সৌন্দর্যপিপাসু। হয়তো দেয়াল, দরজা ভাঙা কিন্তু সবার ব্যালকনি বা উঠানে সুন্দর ফুলের টব, বাগান। যেখানেই গিয়েছি সেই দৃশ্যই দেখছি। 


রাস্তায় বিরতিতে সূর্যমুখি বাগানে পরিবারের সঙ্গে লেখক, জুলাই ২০১৫

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সেই স্টেক এর রেষ্টুরেন্টে এসে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। অনেক বছরের পুরনো এই রেস্টুরেন্টে শুধুই স্টেক পাওয়া যায়। অসম্ভব ভীড় থাকে সবসময়। বিল্ডিং এর ভিতরে রান্না করা হয় আর খাবার সার্ভ করে বাইরে একটা উঠানে। সেখানে হালকা নীলাভ আলোয় ইতালীয় স্টাইলে খাবার দেয়া হয়। বলে রাখা ভালো যে এই শহরে রেস্টুরেন্টে কাঁচের বোতলে পানি ও ড্রিংকস দেয়া হয়।

জীবনে এতো বড় স্টেক আমি দেখিনি। এতো স্বাদের হয় স্টেক! একটা স্টেক দুজন খেতে পারে। ওদের পুরো খাবার (স্টেক) পরিবেশন এর ধরনটা অদ্ভুত সুন্দর। নিভু নিভু আলোয় প্রথমেই স্টার্টার হিসেবে পাননি (পাউরুটি যার উপরটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম) আর জলপাই এর তেল সাথে কিছু কাচা সালাদ। রুটি তেলে চুবিয়ে খেতে হয়। (এই জিনিস আমি মদিনা শরীফে দেখেছিলাম। ঘি তে ডুবিয়ে খুবজ/রুটি খেতে) এই দেশে জলপাই খুবই সস্তা। সবকিছুতেই এরা জলপাই তেল ব্যবহার করে।


২০১৫ সালের জুলাইয়ে ফ্লোরেন্স এর ডোমোর সামনে পরিবারসহ লেখক
 
দ্বিতীয় পর্বে মেইন কোর্স আসে। বিশাল প্লেটে জাম্বো সাইজের একটা বিফ স্টেক আর সাথে কিছুটা রাইস (ফ্রাইড রাইস না কিন্তু জাস্ট স্টীমড এবং একটু শক্ত) আর খুব সুন্দর করে কাটা স্টীমড ভেজিটেবল। যেহেতু আমাদের কেউই হার্ড ড্রিংক করি না তাই কোক সার্ভ করেছে। ওরা এটা ওয়াইন দিয়ে খায়। খেতে খেতে আবারও রুটি দিয়ে যায়। বাবা রে বাবা! এতো খাওয়া যায়? আমি পুরো স্টেক শেষ করতে পারিনি। সে জন্য বকা শুনতে হয়েছে। 

সবশেষে ডেসার্ট হিসেবে দেয়া হয়েছিল পছন্দসই আইসক্রিম যেটা এক স্কুপ চারজন মিলে খেয়েছিলাম কারণ ওই খাবারেই সবার উদরপূর্তি হয়ে গেছে। অনেক রাতে ঘরে ফিরে প্ল্যান হলো পরেরদিন ফিরাঞ্জের (ফ্লোরেন্স) সেই বিখ্যাত ডোম দেখতে যাব।


মাইকেল এঞ্জেলো পার্কে পরিবারের সঙ্গে লেখক, জুন ২০১২

যথারীতি আমরা সকালে নাস্তা করেই রেনেসাঁ’র বিখ্যাত স্থান ফ্লোরেন্স এর মাইকেল এঞ্জেলো পার্ক এর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করি। মাঝে একটু বিরতি নিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য আরেক দেবরের বাসায় থামি। সেখানে গিয়ে দেখি এলাহী কাণ্ড! ওরা কয়েকজন মিলে আমাদের জন্যে বিশাল ইতালীয় খাবারের আয়োজন করেছে। পুরো টেবিল ভর্তি বিভিন্ন রকমের সালাদ সাথে স্থানীয় অনেক মাছ, চিকেন, মাটন, বিফ সব। রান্না করেছে কারণ ওরা সবাই পাঁচ তারকা হোটেলের শেফ। 

গত কয়েকদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত আমরা সবাই খাবারের পর হালকা একটু ভাতঘুম দিয়েছিলাম। জেগে দেখি বিকেল হয়ে গেছে। বেলা যে নেই। মনের দুঃখে সবাই গান গাই ‘ঘুমাইয়া ছিলাম, ভালো ছিলাম, জেগে দেখি বেলা নাই, কোনবা পথে ডোমো দেখতে যাই’..

চলবে...

লেখক: বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা

এমবি//