ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

ক্যাম্পাসের মুখ

নিঃসঙ্গতার ভয় দেখিয়ে লাভ নাই

সাদিকুর রহমান খান

প্রকাশিত : ০৭:১০ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৭:২৩ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

একবার ময়মনসিংহ যাচ্ছি এক স্টাডি ট্যুরে। ফিল্ড স্টাডির জন্য মাঝে মধ্যেই যেতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। তো, বাসের মধ্যে হিন্দি গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশাল নাচানাচি হচ্ছে। আমি জানালার পাশে বসে বই পড়ছি। এক বন্ধু এসে বললো কিরে সাদিক, একা একা বসে আছিস, আনন্দ কর। আমি অবাক হয়ে বললাম, আনন্দই তো করছি। মাসুদ রানা (সিরিজ) ইসরায়েলে আটকা পড়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রে ফেলে দেবে তাকে। নায়িকাটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, বুঝলি! ভীষণ সুন্দরী নায়িকা.....!

ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি তারচেয়েও বেশি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে কোনো অনুষ্ঠান বা প্রোগ্রামে কখনও স্বেচ্ছায় যাইনি। বরং সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি নিজের রুমেই। ছুটি পেলে যখন অন্যরা প্ল্যান করে কোথায় ট্যুরে যাবে, আমি তখন চিন্তা করি- সমরেশের আর কোন বইটা পড়া বাকি আছে? দুইদিনে বইটা শেষ করা সম্ভব হবে তো?

কলেজে পড়াকালীন একদা গভীর রাতে এক বান্ধবী ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো- আমার মনটা খুব খারাপ। কী করি বলতো? আমি বললাম- শিবরামের বই পড়, কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলী। হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাবি। ও বললো- আরে না, ঐ রকম মন খারাপ না, অন্যরকম মন খারাপ।

আমি বললাম- তাহলে হুমায়ুন আহমেদের লেখা বই পড়। শঙ্খনীল কারাগার। মন খারাপে কাটাকাটি হয়ে যাবে। শুনে ওই বান্ধবী অগত্যা ব্লক দিয়ে চলে গেলো। এবার মেজাজ হলো খারাপ আমার। শিবরামের বই নিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। হা হা হা করে হাসতে শুরু করলাম।

আসলে, বইপোকাদের প্রেম বা ব্রেকাপের ভয় দেখাইয়াও খুব বেশি লাভ হবে না। বড়জোর ব্রেকাপের আগে হুমায়ূন পড়তো, ব্রেকাপের পর শীর্ষেন্দু পড়বে -এটাই তফাৎ। এর বেশি কিছু না আসলে।

করোনা কালে লকডাউনে বন্ধু-বান্ধব সবার মন খারাপ। বাসায় কারো সময় কাটে না। অথচ আমি যেন সময়ই পাচ্ছি না। ভার্সিটি বন্ধ পাঁচ মাস, কিন্তু এরইমধ্যে পড়ে ফেলেছি প্রায় দেড়শোটি বই, দিনে অন্তত একটা করে। তবুও মনে হচ্ছে- কিছুই পড়া হলো না! ইশ, আর ক'টা দিন যদি ছুটি থাকতো!!

বইপড়ুয়াদের সবচেয়ে বড় সুবিধা এটাই। ধরুণ, দুইটা ঘরে দুইটা মানুষকে একমাসের জন্য আটকাইয়া রাখলেন। একজন বই পড়ে, আরেকজন বই পড়ে না। কী হবে জানেন? যে বই পড়েনা, সে ঐ নিঃসঙ্গ একমাসে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে। কিন্তু বইপড়ুয়ার কিছুই হবে না। কখনও হিমু তাকে সঙ্গ দেবে, কখনও সে রূপার সাথে প্রেম করবে! কখনওবা আবার সোহানার সাথে ইটিশপিটিশ করবে, আবার কখনও অনিমেষ হয়ে রাজনীতি শুরু করবে।

বই পড়ে পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার এই কল্পনার জগতটা। এই জগতের সন্ধান এবং মালিকানা একান্তই একজন বইপোকার নিজের। স্বামী, স্ত্রী, বাবা, মা, বন্ধু, গার্লফ্রেন্ড কারোরই সেখানে প্রবেশাধিকার নাই।

অনেকের কাছেই এসব আদিখ্যেতা মনে হতে পারে, বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, হাস্যকর পাগলামি মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে ওটাই সত্য, ওটাই একজীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

মানুষকে ভালোবেসে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বইয়ের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা নাই। মানুষ দিয়ে সাজানো জগৎ একসময় শূন্য হতে পারে, বই দিয়ে সাজানো বাগানে বসন্ত থাকে সবসময়ই।

গত রোজার মধ্যে এক বন্ধু ফোন দিয়ে বললো- আরে ব্যাটা বাইরে আয়, সারাদিন ঘরে বসে বসে কী করস? আমি বললাম- খিদা পেটে বাইরে যাবো? তুই কি পাগল? তারচেয়ে ঘরে বসে বই পড়া ভালো। পরে ঈদের দিন বললো, মামা (আসলে- বন্ধু) তুই কই? বের হবি না? ঈদের দিনে বের না হলে চলে? আমি বলি- আজকে আনন্দের দিন, ঈদের দিন। এই দিনে বই না পড়লে চলে?

(লেখক- শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।)

এনএস/