ভারতের প্রতি নেপালের উগ্রতায় তৃতীয় শক্তি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:১৩ পিএম, ২০ জুলাই ২০২০ সোমবার | আপডেট: ১০:২২ পিএম, ২০ জুলাই ২০২০ সোমবার
ভারত ও নেপালের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে বেশ কয়েক মাস ধরেই। ভারতের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ক’দিন আগে বিতর্কিত ভূখণ্ড কালাপানি আর লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছে নেপাল সরকার। সীমান্ত নিয়ে বিবাদ যখন চরমে ঠিক তার মধ্যেই ভারতের বিহারের কিষাণগঞ্জ সীমান্তে তিন ভারতীয়কে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ করা হয়েছে নেপাল পুলিশের বিরুদ্ধে। শনিবার রাতে করা গুলিতে এক ভারতীয় আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই)।
খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারত-নেপাল সীমান্তে এমন ঘটনা ঘটল। গত মাসে বিহারের সীতামারহি বর্ডার পয়েন্টে একটি সংঘর্ষের সময় শূন্যে গুলি ছুড়েছিল নেপালের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।
গত ১৩ জুন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে ২৭৫টি ভোটের মধ্যে ২৫৮ ভোট পেয়ে পাস হয় নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের বিল। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার এ বিল প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারী দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুমোদনও করেছেন। নেপালের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এ বিলের অনুমোদন আটকে দিতে জোর তৎপরতা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে এবং এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছে। নেপালের এই নতুন মানচিত্র তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি জাতীয় প্রতীকেও স্থায়ী চিহ্ন হিসেবে বসবে বলে জানিয়েছে সে দেশের সরকার।
শুধু সীমান্ত নয়, ধর্মীয় ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে নেপাল। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান অবতার শ্রীরাম চন্দ্রের জন্মভূমি নাকি নেপালে এবং রাম নেপালি ছিলেন বলে নতুন দাবি তুলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। এ অবস্থায় চীনের অকুণ্ঠ সমর্থনেই ওলি ভারতের বিষয়ে এত বিতর্ক সৃষ্টি করছেন বলে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোয় খবর হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকির মাধ্যমে দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টি এবং ওলিকে ক্ষমতায় স্থায়ী করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেইজিং।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে ও বাইরে ওলির বিরোধী হাওয়া বইছে। প্রধানমন্ত্রীর গদি টলমল করছে। এমন সময় ওলিকে পদে টিকিয়ে রাখতে মাঠে নেমেছে বেইজিং। কূটনৈতিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা না করে ওলির পক্ষে জোরেসোরে কাজ করছেন রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকি। নেপালের শাসক দলে ওলিবিরোধী শিবিরের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন এই চীনা রাষ্ট্রদূত, যা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে নেপালের রাজনীতিতে। রাষ্ট্রদূত ইয়ানকি রীতিমতো দেশটিতে আলোচনার ঝড় তুলে দিয়েছেন। আর পাঁচজন রাষ্ট্রদূতের থেকে আলাদা ইয়ানকি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় এই নারী প্রায়ই নেপালি নারীর সাজে নিজের ছবি পোস্ট করেন। একই সঙ্গে অন্যদের কাঠমান্ডু ভ্রমণের আমন্ত্রণও জানান। দুই বছর ধরে নেপালে রয়েছেন চীনা এই কূটনীতিক।
নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারিত হয় ১৮১৬ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের রাজার মধ্যে স্বাক্ষরিত সুগাউলি চুক্তির মাধ্যমে। এই দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মুক্ত সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সীমানাজুড়েই নদী। সুগাউলি চুক্তি অনুসারে, নেপালের পশ্চিমে অবস্থিত মহাকালী নদীই হবে দুই দেশের মধ্যকার সীমানা। আপাতদৃষ্টিতে সহজ এই সীমানায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে মহাকালী নদীর উৎস নিয়ে দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের ফলে। নেপালের দাবি, এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিম্পিয়াধুরা থেকে। যে জায়গা লিপুলেখ থেকে পশ্চিম দিকে অনেক ভেতরে। অন্যদিকে ভারতের দাবি, মহাকালী নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিপুলেখ থেকে। এর বিপরীতে নেপাল বলছে, ভারত যে নদীকে মহাকালী নদীর উৎস বলছে, সেটি আসলে ওই নদীরই একটি উপনদী। এদিকে বিতর্কিত ভূখণ্ডটি পড়েছে দুটি নদীর মাঝখানে।
ফলে চুক্তি অনুসারেই নেপাল লিপুলেখ গিরিপথকে নিজেদের দাবি করে আসছে। এদিকে ভারতও গত নভেম্বরে নিজেদের মানচিত্রে কালাপানি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, নেপাল প্রতিবাদ জানালেও কোনো কর্ণপাতই করেনি তারা। নেপালের দাবি, ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর থেকে ভারত নেপালের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডে সেনাচৌকি বসানো শুরু করে। যুদ্ধে হারের পরপরই চীনের গতিবিধি দেখার জন্য তারা নেপালের কালাপানিতে সেনাক্যাম্প তৈরি করে, যেখান থেকে পরবর্তীকালে আর সেনা প্রত্যাহার করেনি, বরং সেনাচৌকির সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়েছে। তবে ভারত বরাবরই এ দাবি অগ্রাহ্য করে আসছে। তাদের দাবি, ১৮৭৯ সালে হওয়া ভিন্ন একটি জরিপের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল এবং নেপালের পূর্ববর্তী রাজারা সেটি জানতেন। চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের পর থেকে তারা এই অঞ্চলে সেনাচৌকি বসিয়েছে এবং কখনোই নেপাল কর্তৃক কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। এর বিপরীতে নেপালের দাবি, ভারত তাদের রাজাকে অনুরোধ করে সেনাচৌকিগুলো রেখেছিল। ফলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তখন ছিল না।
লিপুলেখ গিরিপথে ভারতের রাস্তা নির্মাণের জের ধরে হঠাৎ করেই নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের মতো তীব্র প্রতিক্রিয়া সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে জমতে থাকা তিক্ততার বিস্ফোরণ। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির কাঠমান্ডু সফরের সময়েও হাজার হাজার নেপালিকে রাস্তায় অভ্যর্থনা জানাতে দেখা গিয়েছিল। অথচ এর ঠিক ১৩ মাসের মাথায় নতুন সংবিধান রচনা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে নেপাল। ফলে, নেপালের ওপর অঘোষিত তেল অবরোধ আরোপ করে ভারত। নেপালে জ্বালানি তেলের পুরো চালানই আসে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন থেকে, তাদের সব ট্রাক সীমান্তে আটকে পড়ে। সে সময়ে নেপালের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় পরাশক্তি চীন। জ্বালানি তেল আমদানি করতে অনেকটা বাধ্য হয়েই চীনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় নেপাল। তখন থেকেই নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে ভারতবিমুখতা স্পষ্ট হতে শুরু করে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু হঠাৎ করে নেপাল কোন শক্তিতে ভারতের সঙ্গে এমন আচরণে লিপ্ত হয়েছে তা নিয়ে ভাবছেন অনেকে। ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে সরাসরি বলেই ফেলেছেন যে তৃতীয় একটি দেশ হয়তো নেপালকে উস্কে দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে চীনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন তিনি। ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকও একইরকম সন্দেহ করছেন।
দিল্লিতে বিবিসি বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষও বলছেন, ভারতের সরকার মুখে বলছে না ঠিকই, কিন্তু নেপালের সাথে এই সঙ্কটের পেছনে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি চীনের ইন্ধন নিয়েও তারা গভীরভাবে সন্দিহান।
এসএ/