ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশ

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ১১:০৩ এএম, ২২ জুলাই ২০২০ বুধবার

একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে খারাপ সময় যাচ্ছে বাংলাদেশের। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ভূমিধস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দিশেহারা মানুষ। এসব দুর্যোগের সাথে রয়েছে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাস। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত দেশের মানুষ। অনেকেই অসহায় দিনাতিপাত করছে। অনেকেই না খেয়ে থাকছেন দিনের পর দিন। বাড়িঘর হারিয়ে এখনো খোলা আকাশের নিচে বহু মানুষ। 

একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন আমাদের পিছু ছাড়ছেই না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করছি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে যেসব দেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে বিগত বছর গুলোর চেয়ে এ বছর ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি। এর অন্যতম কারণ দেশে ধারাবাহিক দুর্যোগ। 

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে উৎপত্তি হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এরপর ধেকে হু হু করে বাড়তে থাকে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ধারণা করা হয়, পর্যাপ্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকলে বর্তমানে দেশের সিংহভাগ মানুষই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতো। 

মহামারি করোনার দাপটে টানা ৬৬ দিন লকডাউন থাকলেও স্বস্তি আসেনি মানুষের মনে। বরং বেড়েছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। বেড়েছে ক্ষুধার জালা। দিশেহারা হয়েছে দেশের মানুষ। কাজ নেই, চাকরি নেই, ব্যবসা নেই, কর্মস্থল থেকে ছাটাই, কল কারখানা বন্ধ, পোশাক শিল্প বন্ধ ইত্যাদির ফলে খেটে খাওয়া মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসছে। 

করোনার এই ক্রান্তিকালেই দেশের ওপর আঘাত হানে মহাপ্রলয়ংকরী সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বিগত বছরগুলোতে আইলা, সিডর, ফনী ও নার্গিসের মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও এবারের আম্ফানের আঘাতটি ছিল খুব শক্তিশালী। আম্ফানের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলবর্তী এলাকা। বিধ্বস্ত হয় শত শত ঘরবাড়ি। গবাদি পশু থেকে শুরু করে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। 

একটি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে আম্ফানে এক হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আরেকটি দুর্যোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা হলো জলোচ্ছ্বাস। মূলত প্রবল ঝড়ের থেকেই জলোচ্ছ্বাসের উৎপত্তি। আমরা জানি দেশে ১৮টি উপকূল অঞ্চল রয়েছে। প্রতিবছর জলোচ্ছ্বাসে সেই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটে অসংখ্য প্রাণহানি ও প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।

এরপর শুরু হয় মহামারি বন্যা। পাহাড়ি ঢল আর ভারি বৃষ্টিপাতে সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্রথম দফায় ভয়াবহ বন্যার পর এখন চলছে দ্বিতীয় দফায় বন্যা। এ বন্যায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বন্যা। বর্তমানে বন্যার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গ্রামের পর গ্রাম, ইউনিয়নের পর ইউনিয়ন ডুবে আছে পানিতে। পানিবন্দি বহু মানুষ আজ খাদ্যহীন, বাসস্থানহীন। কষ্টে দিনযাপন করছে লাখ লাখ মানুষ। 

বন্যার পানির অবাধ প্রবেশে পাড় ভাঙছে, ঘর ভাঙছে, ভাঙছে ফসলি ক্ষেত। শিকড় শুদ্ধ উপড়ে নিচ্ছে গাছ। হাট-বাজার বিলীন হচ্ছে। স্বপ্নের বীজতলা সয়লাব হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট ডুবে গেছে। ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। নেই এতটুকু ফাঁকা জায়গা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। এভাবেই থৈ থৈ করছে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার পানি। মাথা গোজার ঠাঁই টুকুও বানের পানিতে ভেসে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন হাজার হাজার মানুষ। ঘর না পেয়ে অনেকেই বাঁধের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। 

দেশে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। একাধিক দফায় বন্যা দেখা দেয়ার কারণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় জনদুর্ভোগ এখন চরমে। ফসলহানি ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে পড়াসহ নানা দুর্ভোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের। কিছু স্থানে এরই মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বলেও স্থানীয় পর্যায়ে খবর পাওয়া গিয়েছে। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে।

বাংলাদেশে আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম বজ্রপাত। বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যাটাও অনেক। বাংলাদেশে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে বজ্রপাতে ২৪৩ জন মানুষ প্রাণ হারান। এবার এককভাবে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে গাইবান্ধা জেলায় (১৩ জন), হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় ১১ জন করে এবং নওগাঁ ও ময়মনসিংহ জেলায় ১০ জন করে। যার মধ্যে শুধু এপ্রিলেই মারা যায় ৭০ জন। এটি আমাদের জন্য অশনি সংকেত।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত গত ১০ বছরে (২০১০-২০২০/জুন) বজ্রপাতে ২ হাজার ৭৭৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ৫২৬, নারী ৪০১ ও পুরুষ ১ হাজার ৮৪৭ জন। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০১০ সালে সবচেয়ে কম মোট ১২৩ জন আর ২০১৬ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৫০ জন নিহত হন। বাকি বছরগুলোতে ২০০ থেকে ৩০০–এর মধ্যে এই সংখ্যা ওঠানামা করে।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কোনো সময় ঘটতে পারে এমন দুর্ঘটনা। তাই ভূমিকম্প-পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরি। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, চীন ও ভারতের তুলনায় প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। ভূতাত্ত্বিকদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নেপালের সমমাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে ও হেলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় তিন লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। একই সঙ্গে প্রায় ৯০ হাজার লোকের প্রাণহানি হবে। এক্ষেত্রে আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।

প্রতিবছর পাহাড় ধসে দেশে অনেক মানুষ মারা যায়। এসব পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিবৃষ্টি, অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, পাহাড়ি বনাঞ্চল কেটে উজাড় করা ইত্যাদি। 

এমব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার। এখন যদি সতর্ক না হই, তাহলে আমাদের পরবর্তী সময়ে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, এর জন্য দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারের তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে দুর্যোগ প্রতিরোধে এখনই স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। আর এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে দুর্যোগ প্রতিরোধে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে দুর্যোগ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে এবং তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্যোগ প্রতিরোধে করণীয় হিসেবে আমরা দুটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করতে পারি। প্রথমত, দুর্যোগ পূর্বকালীন প্রস্তুতি; দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ পরবর্তীকালীন প্রস্তুতি।

প্রথমত, সরকারকে সুষ্ঠু পূর্বপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং গণমাধ্যমের সুষ্ঠু ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে হবে। অগভীর নদী ড্রেজিং করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সম্ভাব্য দুর্যোগের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। রাস্তাঘাট মজবুত করে তৈরি করতে হবে। জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ দ্রুত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। যেখানে সুপেয় পানির অভাব, সেখানে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসস্থল অতিদ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিকভাবে যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সর্বোপরি আগামীতে যাতে এরূপ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে কমানো যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্যোগ-পরবর্তীকালে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সমন্বিত প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক