বেবী আপার সাথে কিছু স্মৃতি
স্বপন ভৌমিক
প্রকাশিত : ০২:২৭ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২০ শনিবার
আজ শ্রদ্ধেয় বেবী আপার ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৯৯৩ সালের কোন এক সময় মতিঝিলের একটি অফিসে কাজ করার সময় বেবী মওদুদ আপার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে আর কখনো কাছ ছাড়া হইনি। কখনও কখনও অনেক কঠিন সময় পার করেছি। কিন্তু আপার উপর আস্থা হারায়নি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠা লগ্নের অনেক কাজ আমাকে দিয়ে করাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমিও অবলীলায় করে যেতাম। আওয়ামী লীগের ‘বুলেটিন’-এর কাজ করার সময় অনেকবার বিএনপি সরকারের হয়রানির শিকার হয়েছি। তারপরও আপার ওপর বিশ্বাস রেখে সাহসের সাথে কাজ করেছি। উনার সাহস প্রত্যয় আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করতো। পারিশ্রমিক কত পাবো না পাবো সে ব্যাপারে কখনও হিসাব করিনি তখন। আপার কাজ করবো, এটা একটা মহান দায়িত্ব মনে করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আপা সেটিসফাইড না হতেন ততক্ষণ পর্যন্ত কাজ করে যেতাম।
১৯৯৮ সালে শ্রদ্ধেয় রেহানা আপার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ প্রকাশের শুরু থেকে যুক্ত হয়েছি। এখানেও অনেক চড়াই উতরাই পার হতে হয়েছে। অবশেষে ২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের প্ররোচনায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেল। আবার শুরু হলো অনিশ্চিত যাত্রা। তখনও বেবী আপা সাহস দিয়েছিলেন। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি, উনার সাথে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। কর্মক্ষেত্রে এখন বেবী আপার অভাব বোধ করি। আমি উনার বিদেহী আত্মার অপার শান্তি কামনা করছি।
সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করার সময় বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা কিছু বইয়ের কাজ করেছি। বেবী আপাই সেগুলো দেখাশোনা করতেন। ওরা টোকাই কেন, সহেনা মানবতার অবমাননা সহ আরও অনেক প্রকাশনার কাজ করতে গিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিচিত্রার কাজের অবসরে এ ধরনের প্রকাশনার কাজগুলো হরহামেশাই করেছি। দেখতে দেখতে সুদীর্ঘ সময় পার করে এসেছি পেছন ফিরে তাকালে নিজের কাছেই অবাক লাগে।
কাজের মধ্যে আপার ধমক যে একআধটু খাই না তা নয়। ভুল করার জন্য বকাবকি যেমন খেয়েছি। কখনও কখনও ভুল না করেও ধমক খেয়েছি। এই ধমকের মধ্যেও শেখার অনেক ব্যাপার ছিল। এর মাধ্যমে তিনি অনেক কিছু শিখিয়েছেন। যা আমার পরবর্তী কর্মজীবনে এখন কাজে লাগছে। বকাবকি করে কিছুক্ষণ পরই আবার কাছে ডেকে নিতেন। ঠিক পরিবারের বড়রা ছোটদের সাথে যেমন করে। তাই অফিসে কাজ করে কখনও মনে হয়নি ঘরের বাইরে আছি। সবসময় মনে হতো এটা আরেকটা পরিবার। যেখানে বেবী আপার মতো একটি বটবৃক্ষ আছে। আমার আর কোনো ভয় নেই। যত ভুলই করি উনি শিখিয়ে নিবেন। আমার এখন মনে খুব কষ্ট হয়, বেবী আপার মতো একজন বটবৃক্ষের ছায়া থেকে আমি বঞ্চিত হলাম। এখন পরিবারের বড় বোনের মতো কেউ কাছে ডেকে নেয় না, ধমকও দেয় না, খবরও রাখে না।
বেবী মওদুদ আপা কত মানুষের যে কাজ করে দিতেন তার হিসাব করে শেষ করা যাবে না। কেউ প্রকাশনার কাজ শেষ করতে পারছেনা আপার কাছে আসলো, বুঝিয়ে বললো, আপা মানুষকে অনুরোধ করে নিজ দায়িত্বে ওই কাজটা শেষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। এরকম তাঁর সাথে অনেক কাজ করেছি আমি। এভাবেই সময় কাটাতে দেখেছি বেবী আপাকে। কখনও নিজের জন্য কিছু অর্জন করার চিন্তা করতে দেখিনি। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখিনি। এখন এটা ভেবে চমকিত হয়ে যাই। এরকম মানুষ এখন আর দেখি না। কোনো সময় সমস্যায় পড়ে উনাকে না জানালে খুব রাগ করতেন। আর এখনতো কেউ কথাই শুনতে চায় না। বেবী আপার মতো নিঃস্বার্থ ও নিরহঙ্কারী মানুষের সাথে কাজ করাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
প্রতি সপ্তাহে নিজের বাসায় রান্না করে অফিসে খাওয়ানো একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। একেক সপ্তাহে একেক রকম ম্যেনুর খাওয়ার খাওয়ানো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কোনো সপ্তাহে খাওয়ানো মিস হলে উনি নিজেই মন খারাপ করতেন।
প্রতি সপ্তাহে বিচিত্রার পাতায় ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে একটি পাতা নিজে লিখতেন। লেখাটা হাতে দিয়ে মতামত জানতে চাইতেন। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষ উনার লেখার ব্যাপারে কি মন্তব্য করবো! কোনো অন্যায় বা কারও ওপর দোষারোপ করে কোনো লেখা উনাকে লিখতে দেখিনি।
আর্থিক কোনো স্বার্থের জন্য উনার সামনে কখনো দাঁড়াইনি। তবে তিনি বুঝতেন অনেক কষ্ট করেই চলছি। অফিসের অবস্থা উন্নতি করার জন্য চেষ্টা করেছেন সবসময়। মাঝে মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন।
সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিগুলোও হারিয়ে যায়। কিন্তু আবেগটা রয়ে গেছে। হয়তো এ আবেগটা থেকে যাবে মৃত্যু পর্যন্ত। সবকিছু কাগজে লিখে বা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। মানব হৃদয়ের অনুভুতি একমাত্র উপলব্ধি।
বেবী আপা আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আপনার মতো একজন অভিভাবক খুঁজে বেড়াই নিরন্তর। পাবো কি-না জানিনা, তবে আপনার সাথে কাজ করার স্মৃতি বহন করছি নিরন্তর।
এমবি//