ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

যুব বাজেট নিয়ে সানেম ও একশনএইড’র ওয়েবিনার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:০৬ এএম, ২৬ জুলাই ২০২০ রবিবার

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের কাছে ইয়ুথ বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক বা তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বাজেট কাঠামো-র ধারণা পরিচিত করার লক্ষ্যে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও একশন এইড বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আজ “ইয়ুথ বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক: এন এপ্রেইজাল” শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজিত হয়। 

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইয়াং বাংলার আহ্বায়ক নাহিম রাজ্জাক। ওয়েবিনারটিতে সভাপতিত্ব করেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান ওয়েবিনারটি পরিচালনা করেন।

ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেম এর সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট ইশরাত শারমীন। একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরবর্তীতে প্রবন্ধটির ওপর আলোচনা করেন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন তালুকদার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাজিবুল ইসলাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ যুগ্ম সচিব ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপসচিব মোসাম্মত ফেরদৌসী বেগম, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় উপ সচিব খাদিজা নাজনীন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যন বিভাগ অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ। 
ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ জুমের মাধ্যমে পরিচালিত এ ওয়েবিনারে প্রায় পঞ্চাশ জন অংশগ্রহণকারী যুক্ত হন। ওয়েবিনারটি সানেম এর ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

সূচনা বক্তব্যে, ড. সেলিম রায়হান ওয়েবিনারটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন এবং তরুণ-যুবদের উন্নয়নের গুরুত্বের ওপর আলোচনা করেন। তিনি জনমিতির লভ্যাংশের যথাযথ ব্যাবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বাজেট কাঠামোর মৌলিক কিছু ধারণাও তিনি ব্যাখ্যা করেন।

স্বাগত বক্তব্যে ফারাহ কবির তরুণ-যুবদের উন্নয়নে তার এবং তার সংগঠনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তরুণ কেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচীর গুরুত্ব নিয়ে তিনি সবিস্তার আলোচনা করেন।

উপস্থাপনায় ইশরাত শারমীন তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বাজেট কাঠামোর ধারণাটি তুলে ধরেন। তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের তরুণদের আশা-আকাঙ্খার কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে সে সম্পর্কে তার মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, বাজেটে নতুন দরিদ্র্যদের জন্য, বেকারদের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ দেয়া হয় নি। বাজেটে তরুণ-যুব কেন্দ্রিক প্রজেক্টগুলোকে যথেষ্ট
সম্প্রসারিত করা হয় নি, তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গও উঠে আসে নি। অনানুষ্ঠানিক খাতের বেকার, তথ্য-প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত দরিদ্রদের নিয়ে বাজেটে কোনো আলোচনা হয় নি। শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।

তিনি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কতটা তরুণ-যুব বান্ধব সেটির একটি মূল্যায়ন উপস্থাপন করেন। ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এগুলোর বাজেটের অর্ধেকের বেশি যুব কেন্দ্রিক না। বরাদ্দের মাত্র ৯ শতাংশ তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বলা যায়।

ইশরাত শারমীন ব্যাখ্যা করেন যে, ইয়ুথ বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক বা তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বাজেট কাঠামো হচ্ছে তরুণ-যুব কেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বিত কর্মপন্থার আর্থিক প্রস্তাবনা। তরুণ-যুবকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতায়িত করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই তরুণ-যুব কেন্দ্রিক বাজেট। তিনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তরুণ-কেন্দ্রিক বাজেটগুলোর
নিয়েও একটি ধারণা দেন।

এ ধরণের বাজেট কাঠামো প্রণয়ণের প্রক্রিয়াটি তিনি ব্যাখ্যা করেন এবং এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ-যুব সংক্রান্ত নীতিগুলো নিয়েও সংক্ষেপে আলোচনা করেন। বাজেট কাঠামো তৈরীর ক্ষেত্রে তরুণ-যুবকদের উন্নয়নে প্রভাবিত করছে যে উপাদানগুলো সেগুলোকে প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে বলেন তিনি। তিনি বলেন এগুলো হচ্ছে মূলত: স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, আয়, দারিদ্র্য ও
পারিবারিক সহিংসতা। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোকে এই কাঠামো তৈরীর একটি প্রণালী ছক বা টেমপ্লেট দিতে হবে যেটি প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হবে এবং যেটি পূরণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট হিসেবে সহায়তা করতে পারে এবং স্বচ্ছতার জন্য বিশ্লেষণ করতে পারে। তৃতীয়ত, বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর এবং পরিচালন ব্যয় কতটা তরুণ কেন্দ্রিক সেটির বিশ্লেষণ করতে হবে।

এই কাঠামো বাস্তবায়নে নির্ভুল তথ্য, প্রাতিষ্ঠানিক বাধা চিহ্নিতকরণ, আন্তঃ-মন্ত্রণালয় সহযোগিতা, সম্পদের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার ও দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি মন্ত্রব্য করেন যে, এই বাজেট কাঠামো জনপ্রিয় করে তুলতে হবে, প্রণয়ণের আগে অংশীজনদের মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে, লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করতে হবে, আর্থিক কৌশল নিয়ে সচেতন হতে হবে। সর্বোত্তম
ফলাফলের জন্য অংশগ্রহণমূলক পন্থা গ্রহণ করতে হবে বলেও তিনি ব্যাখ্যা করেন। তিনটি পর্যায়ে এই কাঠামো প্রণয়ন করা হবে: প্রস্তুতি, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন।

প্যানেল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা সানেম ও একশনএইড বাংলাদেশের এই প্রস্তাবনা কে স্বাগত জানান। তারা এই কাঠামোর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন এবং সরকারের তরুণ-যুব কেন্দ্রিক কর্মসূচীগুলোর ওপর আলোকপাত করেন।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, তরুণদের সৃজনশীলতা ও নেতৃত্ব গুণ কে উৎসাহিত করতে হবে। তরুণ-যুব, বেকার তরুণ, এবং যে তরুণরা শিক্ষা, চাকরি বা ট্রেনিং কোনোকিছুতেই জড়িত নন—তাদের তথ্য নিয়ে একটি ডাটাবেইজ স্থাপনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। প্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন
যে, মন্ত্রণালয়গুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন তালুকদার, তরুণ-যুবদের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নিয়েও আলোচনা করেন। মোহাম্মদ নাজিবুল ইসলাম, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তরুণ-যুব কেন্দ্রিক কর্মসূচীগুলোকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন রাতারাতি বরাদ্দ বৃদ্ধি করে লাভ হবে না, যদি না সেটিক পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহার করা যায়। তিনি আরো বলেন যে বিদেশের শ্রম বাজার অনুসন্ধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন তরুণদের জন্য কারিগরি শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সংক্রান্ত বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। 

মোসাম্মত ফেরদৌসী বেগম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তরুণ-যুব কেন্দ্রিক কর্মসূচীগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি উপস্থাপিত বাজেট কাঠামোর গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং বলেন যে শুধু বাজেটই নয় একটি কর্মপরিকল্পনাও দরকার।

খাদিজা নাজনীন, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত তরুণ-যুবদের জন্য ট্রেনিং কর্মসূচীগুলো সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। তিনি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করেন। কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে শ্রম বাজারের সংযোগ গড়ে তোলা দরকার বলে মন্তব্য করেন ড. আবু ইউসুফ।

একশনএইড বাংলাদেশের নাজমুল আহসান বলেন গৃহীত নীতিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। সার্বিক আলোচনার ওপর মন্তব্য করে ফারাহ কবির বলেন, একশনএইড বাংলাদেশ সানেমের সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এই কাঠামো নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক। তরুণ-যুবদের উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির লেন্স দিয়ে দেখলেই হবে না, তাদের সামাজিক ও মানসিক উন্নয়ন নিয়েও চিন্তা করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্য নাহিম রাজ্জাক, সানেম এবং একশনএইড বাংলাদেশের প্রস্তাবনা ওগবেষণার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন,  আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় খুবই জরুরী। তিনি একটি সমন্বয় সেল এর প্রস্তাব করেন, যেটি একটি উপদেষ্টা প্যানেলের সহায়তা অংশীজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তাব পেশ করবে। তিনি তরুণ-যুবদের ওপর মানসম্মত তথ্য-
উপাত্ত সংগ্রহের ওপর জোর দেন এবং এক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ব্যুরোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এখনো সেরকম কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে নি। তিনি ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট একশন প্ল্যান এবং ইয়ুথ কাউন্সিল এর প্রস্তাব করেন। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের ওপরও তিনি জোর দেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আগের চেয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ে উন্নতি হয়েছে। তিনি সানেম এবং একশন এইড কে ধন্যবাদ দেন এ ধরণের বাজেট কাঠামোর প্রস্তাব পেশ করার জন্য। থিংক ট্যাংক ও বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব ও পরামর্শ নীতি প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরো বলেন যুব ও তরুণ উন্নয়নে সরকার ও তার মন্ত্রণালয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সমাপনী বক্তব্যে ড. সেলিম রায়হান আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে সকলের সহায়তায় তরুণ-যুব
কেন্দ্রিক বাজেট কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

আরকে//