ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

কুরবানির খরচ কমিয়ে দান করুন

মাওলানা সৈয়দ মুস্তাফা মুনিরুদ্দিন

প্রকাশিত : ১২:২১ এএম, ২৬ জুলাই ২০২০ রবিবার

ইহকালে ও পরকালে ভাল থাকার জন্য আমাদের উচিত মানুষের দুঃখে কষ্টে নিশ্চুপ বসে না থেকে সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে আসা। এই করোনার দুর্যোগকালে অভাবী অসুস্থ কর্মহীন মানুষের পাশে অর্থ, খাদ্য ও অন্যান্য সেবা (যেমন চিকিৎসা সেবা, দাফন সেবা ইত্যাদি) নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত নবীজীর (স.) সত্যিকার অনুসারীদের। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে যে, এই দুর্যোগ সময়ে ভাল কাজের অনেক সুযোগ থাকার পরেও অনেকেই তা গ্রহন করছেন না বা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ভাল কাজে এগিয়ে না এসে অনেকে ঘরে বসে সামাজিক মাধ্যমে গাল গল্প আর খাবার পোশাকের ছবি পোস্ট করছেন। তারা নিজের বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করুন, নবীজী এই সময়ে কী করতেন? তাঁর আদর্শ সাহাবীরা এই সময়ে কী করতেন? তিনি কি মানুষের কষ্টে নির্বিকার বসে থাকতে পারতেন?

সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর কুরবানী ওয়াজিব। যারা প্রতি বছর কুরবানি দেন তাদের কাছে এবার প্রত্যাশা করি, তারা কুরবানির জন্য বরাদ্দ করা বাজেট থেকে কিছুটা দান করবেন ত্রাণ, দাফন ইত্যাদি কাজে। দান করবেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। যারা সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করছে মানবতার জন্য। কেউ ত্রাণ বিতরণ করে, কেউ নগদ অর্থ বিতরণ করে। কেউ করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিকে সম্মানজনক শেষ বিদায় জানানোর জন্য কাজ করছে। কারও হয়তো নগদ অর্থ প্রয়োজন। কোন সংগঠনের প্রয়োজন চাল ডাল তেল ইত্যাদি নিত্যপণ্য। কোন সংগঠনের হয়তো এম্বুলেন্স বা ফ্রিজিং ভ্যান হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া সহজ হয় মৃতদেহ উদ্ধার করতে বা দাফন করতে। কুরবানির খরচ কমিয়ে এই দানগুলো করতে ধর্মীয়ভাবে কোন বাধা নেই। কারণ, ইসলাম মানবতার ধর্ম। কুরবানির পশু কত টাকায় কিনবেন সে বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা ধর্মে আরোপ করা হয় নি। কাজেই গত বছর যদি এক লাখ টাকায় গরু কিনে থাকেন তো এ বছর ৫০ হাজার টাকায় কিনে বাকি ৫০ হাজার টাকা দান করতেই পারেন। গত বছর যদি দুই ভাগ দিয়ে থাকেন তো এ বছর এক ভাগ দিন। কিংবা ভাগ প্রতি খরচ কমিয়ে আনুন।

কেউ কেউ বলবেন, কুরবানির মাংস দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করাও এক ধরনের দান। কিন্তু সেই দানে প্রকৃত দরিদ্রদের কতটা উপকার হবে ভেবে দেখা দরকার। বড় শহরগুলোতে ধনীদের কুরবানীর মাংস বিতরণ করা হয় তাদের বাড়ির সামনে থেকে। লাইন ধরে বা মিছিল করে সেই মাংস নিতে আসেন দরিদ্ররা। সারা দিন এত মাংস সংগ্রহ করেন তারা যে দিন শেষে সেই মাংস বিক্রি না করে উপায় থাকে না। কারণ মাংস সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ তো আর তার বাসায় নেই। কতদিন আর মাংস রান্না করে বা শুকিয়ে রাখা যায়? কাজেই মাংস বিক্রি হয়ে যায়। চলে যায় বিভিন্ন খাবার হোটেলে। তারচেয়ে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তার প্রয়োজন অনুসারে অর্থ দান করা অনেক বেশি মানবিক। অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

যদি সবাই নিজ নিজ কুরবানির খরচ কমিয়ে দান করেন তাহলে এবার বড় পশু কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে যাবে বলে আশা করা যায়। হ্রাস পাবে লোক দেখানো কুরবানি করার প্রবণতাও। খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি, মানুষ কুরবানির সময় কোন পশুর কত দাম, কোন পশুতে কত কেজি মাংস হল, প্রতি কেজি মাংস তাহলে কত করে পড়ল, কোন গরুর মাংস কতটা সুস্বাদু হবে ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা বলে পরস্পরের সাথে।

খুব বেদনাহত হই, যখন দেখি কুরবানি ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও শুধু সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য বা সম্মানহানির আশংকায় মানুষ কুরবানি দেন। এই নিয়ত থেকে দেয়া কুরবানি তো কুরবানি হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা নয়! আল্লাহই ভাল জানেন, তারা মাংস খাওয়া ছাড়া আর কোন উপকার পাবেন কিনা! যদি কুরবানির খরচ কমিয়ে এবার আমরা দান করি তাহলে বন্ধ হবে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্রিজ ভর্তি করার অসৎ চর্চাটি। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে এই চর্চা চলে আসছে। অনেক দিন ধরে ডিপ ফ্রিজে মাংস জমিয়ে জমিয়ে খাওয়া মোটেই ভাল কিছু নয়। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও ভাল নয়। আত্মিক উন্নতির জন্যও ভাল নয়। কেননা, মাংস অনেক দিন ধরে জমিয়ে খাওয়া, প্রকৃত পক্ষে, আমাদের নীচু সংকীর্ণ ও কৃপণ মানসিকতারই পরিচয় প্রকাশ করে।

এ বছর সঙ্গত কারণেই অনেকে হজে যেতে পারলেন না। যারা হজে যেতে পারলেন না এবার তারা কি সেই অর্থ আপাতত দান করতে পারবেন অভাবীদের জন্য? আল্লাহ চাইলে বহুগুণে ফিরিয়ে দেবেন আবার। আল্লাহ চাইলে আগামী বছর বা তার পরে কখনো হজে যেতে পারবেন; কিন্তু এ বছর একজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়তো বারবার আসবে না। হজের জন্য যা লাগে তা বিত্তবানদের কাছে খুব বেশি অর্থ তো নয়! রাবী ইবনে সোলায়মান যদি পেরে থাকেন তো বিত্তবানরা পারবেন না কেন? বিত্ত বাড়লে চিত্ত কমে যাবে – এমন তো কোন কথা নেই!

নবম শতকের এক হজ মৌসুম। উটের কাফেলায় চড়ে হজে রওনা হয়েছেন বিখ্যাত বুজুর্গ রাবি ইবনে সোলায়মান। পথে বিশ্রামের জন্যে এক শহরের বাজারে থামলে দেখা পান এক নারীর। ভাগাড়ে পড়ে থাকা মৃত একটি খচ্চরের দেহ থেকে ছুরি দিয়ে মাংস কাটছে নারী।

রাবি ইবনে সোলায়মান ভাবলেন, এ বোধ হয় এই মাংস বাজারে বিক্রি করবে। পিছু নিলেন তার। পৌঁছালেন নারীর বাসস্থান জীর্ণ কুটিরে। শুনলেন নারী তার কন্যাদের বলছেন, “আর চিন্তা নেই বাছারা। খাবার এসে গেছে। একটু পরেই তোমরা মাংস খাবে’’। শুনে ইবনে সোলায়মান আঁতকে উঠলেন। তার মানে মা তার সন্তানদের মৃত পশুর মাংস খাওয়াচ্ছে! চিৎকার করে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহর ওয়াস্তে এ মাংস তোমরা খেও না। এ মাংস এক মৃত পশু থেকে নেওয়া!  নারী তো ক্ষিপ্ত! এ কি করলেন আপনি?

আজ চারদিন এ এতিম শিশুগুলো অন্নহীন! কত কষ্টে কিছু খাবার যোগাড় করলাম। আর আপনি তা নষ্ট করে দিলেন! রাবি ইবনে সোলায়মান স্তম্ভিত! এত দারিদ্র্যও হতে পারে! জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানদের বাবা কোথায়? নারী বললেন, স্বামী তো খুব
নেককার মানুষ ছিলেন! সৎ ছিলেন। কিন্তু সঞ্চয় কিছু ছিল না! আজ এক বছর হলো তিনি মারা গেছেন। সেই থেকে আমাদের দিন চলছে নিদারুণ অর্থকষ্টে! রাবি ইবনে সোলায়মান সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন বাজারে। নিজের সঞ্চয় দিয়ে ধামা ভরে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এলেন। তাদের হাতে দিয়ে বললেন, এই নাও কিছু খাবার। কয়েকদিন এ দিয়ে চলবে। আর এই হলো কিছু অর্থ। বলে হযরত সোলায়মান তার কাছে থাকা বাকি সমস্ত অর্থ দিয়ে দিলেন। হজে আর তার যাওয়া হলো না। ফেরা হলো না নিজের দেশেও। পথের খরচ যোগাড়ের জন্যে ঐ শহরেই একটা কাজ জুটিয়ে থেকে গেলেন। এদিকে সহযাত্রীরা যখন
হজশেষে ফেরত যাত্রায় আবারো কাফেলা থামাল, রাবি ইবনে সোলায়মান সবার কাছে দোয়া চাইতে লাগলেন। বললেন, তোমরা তো হজ করে এসেছ। আমার জন্যে দোয়া করো।

তারা বলতে লাগল, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? হজে তো আপনি আমাদের সাথেই ছিলেন! আরেকজন দৌড়ে এসে বলল, আরে এই তো, আপনি এখানে! কি যে হন্যে হয়ে খুঁজছি আপনাকে। তাওয়াফ শেষে আশরফির এই থলেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেই যে উধাও হলেন, আর তো আপনার দেখা নেই! থলে বইতে বইতে আমার তো হাত ব্যথা হয়ে গেছে। সবকিছুই রাবি সোলায়মানের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। থলে খুলে দেখেন ৬০০ স্বর্ণমুদ্রা! রাতে স্বপ্নে শুনলেন ঐশীবাণী- তার দান প্রবণতায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তার রূপে এক ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবার হজে যে তার হয়ে হজ করেছে। এবং
হজশেষে ৬০০ স্বর্ণমুদ্রার একটি থলেও দিয়েছেন তার সেই ৬০০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে, যা হতদরিদ্র পরিবারটিকে রাবি ইবনে সোলায়মান দিয়েছিলেন!

আমরাও যদি দান করি অন্তর থেকে, যদি দান করি এই দুযোর্গকালে অসহায় মানুষের কল্যাণের জন্য তো নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করবেন। তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখবেন। কুরবানির বাজেট কমিয়ে দান করায় যেহেতু কোন ধর্মীয় বাধা নেই সেহেতু এই সময়টা হতে পারে আমাদের দানের জন্য একটি বড় সুযোগ।

মাওলানা সৈয়দ মুস্তাফা মুনিরুদ্দিন
লেখক, স্বেচ্ছাসেবী করোনাযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান, আল হিদায়াহ বাংলাদেশ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, চট্টগ্রাম

আরকে//