ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৯ ১৪৩১

অবৈধ দখলে ৪০ ফুটের রাস্তা এখন অর্ধেক, নেই কার্যকরি পদক্ষেপ

নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৫:৫০ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২০ রবিবার | আপডেট: ০৫:৫১ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২০ রবিবার

নওগাঁ শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কের মধ্যে অন্যতম নওগাঁ-দুবলহাটি সড়ক। ৪০ ফুট প্রশস্থের এই সড়কের উভয় পাশে অবৈধ দখলের তাণ্ডবে এখন এর প্রশস্থতা ১৫ থেকে ২০ ফুটে এসে ঠেকেছে। 

রাস্তার উভয় পাশে কেউ বাড়ির বারান্দা, দোকান ঘর, সংগঠনের অফিস আবার কেউ সড়কের ৪টি পয়েন্টে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ শতক জায়গার উপর অবৈধভাবে তিনতলা পাকা ভবন নির্মাণ করে দখল পাকাপোক্ত করেছে। আবার ওইসব ভবন নির্মাণে পৌরসভা থেকে প্লানও নেওয়া হয়েছে। 

সর্বশেষ এক বছর আগে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অবৈধ দখলের স্থান চিহ্নিত করে ওইসব দখলদারদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন জানানো হয়। যেখানে উচ্ছেদ কাযক্রম সম্পন্ন করতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকরি কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

এছাড়া ওই সড়কের অবৈধ উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ৮ বছর ধরে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও অনেক আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল হয়নি। এতে করে একদিকে যেমন এলাকার সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্ঠি হয়েছে। তেমনি অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্বও বেড়েছে।

এদিকে আগামী ১ মাসের মধ্যে জনগুরত্বপূর্ণ সড়কটির অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে জনসাধরণের চলাচলের পথ সুগম করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছে এলাকাবাসী।

সরেজমিন ও এলাকার একাধিক মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নওগাঁ জেলায় যে কয়েকজন জমিদার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার দুবলহাটি এলাকার রাজা রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী। ওই জমিদার দুবলহাটি এলাকায় বসবাসের জন্য বিশাল একটি রাজবাড়ী তৈরি করেছিলেন। ১৮৫০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে রাজা ও তার ছেলে কৃঙ্করীনাথ রায় চৌধুরী দুবলহাটি বাজারে হরনাথ রায় উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেন।
 
তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা সদর থেকে দুবলহাটি রাজবাড়ীতে যেতে হতো হাপানিয়া হয়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার ঘুরে। পরে অল্প সময়ে ও সহজে যাতায়াত করার জন্য রাজা আনুমানিক ১৯০০ সালের দিকে শহরের গোস্তাহাটির মোড় হতে বিলের ভিতর দিয়ে ৪০ থেকে ৫০ ফুট প্রশস্থ ৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেন। এই রাস্তা দিয়ে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে যাতায়াত করতেন। 

ওই রাস্তায় ঘোড়ারগাড়ি চলাচলের ফলে ঘোড়ার উচ্ছিষ্ট প্রসাব-পায়খানায় সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছে এমন অভিযোগে স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা আস্তান মোল্লার দাবিতে ওই রাস্তার ৪টি পয়েন্ট মূল রাস্তার বাহিরে নকশা অনুযায়ী ৩০৫২, ৩১২৫, ৩১৮৬ ও ৪৮৫২ দাগে ৩২ শতক সম্পত্তিতে ঘোড়ার শৌচাগার ও বিশ্রামের জন্য ঘরও তৈরি করা হয়। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ও দেশ বিভাগের পর রাজা হরনাথের পরিবার ভারতে চলে যান। 

এ সময় রাজবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের অধীনে ও অন্যান্য জায়গা-জমি নওগাঁ পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও সরকারের খাস খতিয়ান ভুক্ত হয়। 

দীর্ঘদিন এই রাস্তার প্রতি নজর না থাকায় যে যার মত ওই ৩২ শতক সম্পত্তিসহ রাস্তার জায়গা দখল করে পাকা ভবনসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করে বসবাস করে আসছে। আর রাস্তাটি সংকীর্ণ হতে হতে এখন এর প্রশস্থতা এসে ঠেকেছে ২০ থেকে ২৫ ফুটে। বর্তমানে ওই সড়কের উভয় পাশে প্রায় সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে বলে এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেছেন।

এদিকে ১৯৭১ সালের পর ওই সড়কের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। ওই সড়কের দুই পাশের মহল্লায় অনেক ভিআইপিদের বসবাস। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাণিজ্যমন্ত্রী মরুহম আব্দুল জলিলের গ্রামের বাড়ি ও তার কবর রয়েছে। 

এছাড়া সাবেক সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী মো. ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক, সাবেক ক্যাবিনেট সেক্রেটারি মাহবুবুজ্জামান, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আতাউল হক মোল্লা, সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জাকারিয়া হোসেন, চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রির এবং জেলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আলহাজ  জাহাঙ্গীর আলম, লে. কর্নেল আব্দুল লতিফ খান রয়েছেন।  

আবার এই রাস্তায় আঞ্চলিক সমবায় ইন্সটিটিউট, পলেটেকনিক ইন্সটিটিউট, উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় হাউজিং ষ্টেট শাহানাবাগ সিটিসহ অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু তাই নয় ১৯৭৩-এর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সড়ক দিয়ে হেটে এলাকার সবচেয়ে বড় দিঘলীর বিলে  জনসভা করেছিলন। 

আবার ওই রাস্তাকে কেন্দ্র করে দিঘলীর বিল, হাসাইগাড়ী বিল, তালতলি ও শাহানাবাগ সিটি পার্ক নামে বেশ কয়েকটি বিনোদন স্পট গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এসব বিনোদন স্পটে হাজার হাজার মানুষ ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। 

এছাড়াও নওগাঁ সদর উপজেলার দুইটি ও মান্দার ৩টি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের যোগাযোগের একমাত্র পথ দুবলহাটি সড়ক। 
ক্রমেই সড়কটি ব্যস্ততম সড়কে পরিণত হলেও এখন পর্যন্ত অবৈধ দখলমুক্ত করে সড়কটির নকশা অনুযায়ী প্রশস্থ করা হয়নি।

এতে করে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘন্টা ওই সড়কে মারাত্মক যানজটে নাকাল হয় চলাচলকারীরা। আর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। 

এদিকে নওগাঁর চেম্বার অব কমার্স ও জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক কমিশনাররাসহ এলাকার শতাধিক মানুষ ২০১২ সালের দিকে ওই সড়কের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে নওগাঁ পৌরসভা বরাবরে আবেদন করেন। সে অনুযায়ী পৌরসভার সার্ভেয়ার দিয়ে অবৈধ দখলের ডিমার্কেশানও করা হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে উক্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে পৌর কর্তৃপক্ষ নিরব হয়ে যান। 

এলকাবাসীর অভিযোগ, উল্টো পৌর কর্তৃপক্ষ ওই সব অবৈধ দখলদারদের পৌর প্লানও অনুমোদন করে দিয়েছেন। 

একইসাথে ২০১৫ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সার্ভেয়ার দিয়ে সরজমিন ওই সড়কে অবৈধ দখলের ডিমার্কেশান করে নকশা তৈরি করেন। সেই নকশাসহ ২০১৬ সালে অবৈধ দখল উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা পরিষদের চেযারম্যান জেলা প্রশাসক বরাবরে পত্র দেন। 

এ নিয়ে নোটিশ, চিঠি চালাচালি হয় এবং সর্বশেষ জেলা পরিষদের পত্রের আলোকে গত বছরের ৩০ জুন ৪৫৭নং স্বারকে অবৈধ দখল উচ্ছেদে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেন জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু গত এক বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও নেওয়া হয়নি কার্যকর কোন পদক্ষেপ।

এ ব্যাপারে চেম্বারের সাবেক সভাপতি আলহাজ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'ওই সড়কের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য ২০১২ সাল থেকে প্রচুর আবেদন নিবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকরি কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ভু-সম্পত্তি জবর দখল বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিং করার গঠিত জেলা কিমিটি এবং জেলার উন্নয়ন মাসিক সমন্বয় সভায় একাধিকবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও তা কার্যকর হয়নি।'

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একে এম ফজলে রাব্বী আক্ষেপ নিয়ে বলেন, 'সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সড়কের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনিতেই শহরের লোকসংখ্যা ও যানবাহন কয়েকগুন বেড়েছে। অথচ শহরের সড়কগুলো অপ্রতুল হয়ে পড়েছে।'

বিদ্যমান এসব রাস্তা নকশা অনুযায়ী রক্ষা করা না গেলে একদিকে যেমন এলাকার উন্নয়ন ব্যহত হবে। অনদিকে জনসাধরণের দুর্ভোগ আরো বাড়বে বলেও জানান তিনি।

জানতে চাইলে নওগাঁ নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. সালাউদ্দীন মিন্টু বলেন, 'দুবলহাটি সড়কসহ শহরের সকল রাস্তার অবৈধ স্থাপনা আগামী এক মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প থাকবে না।'

এদিকে নওগাঁ পৌরসভার মেজর আলহাজ নজমুল হক সনি বলেন, 'সড়কের উচ্ছেদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।' ওই সব সম্পত্তির ওপর কিভাবে প্লান দেওয়া হয়েছে তাও ক্ষতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশীদ বলেন, 'বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

এআই/এমবি