করোনায় ঘরবন্দি হয়ে কেমন কাটছে ৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
আশিক আরেফীন, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত : ১২:০১ এএম, ২৮ জুলাই ২০২০ মঙ্গলবার
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের আক্রমণে যখন সারাবিশ্বের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তখন বাংলাদেশের মানুষের আক্রান্ত হওয়ার মাত্রাও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অদৃশ্য এই ভাইরাসের দ্বারা ধনী, গরীব, শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ সহ সকল স্তরের জনগণ আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দেশের এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ১৭ মার্চ থেকে ৬ ই আগস্ট পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঈদ, পুজো কিংবা বড় দিনের ছুটি মানেই শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দের একটি বিষয়। কিন্তু ছুটি যদি হয় ঘরবন্দি হয়ে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার জন্য, তাহলে সেই অবসর সময় গুলো কেমন হতে পারে? সেই অনুভূতির কথাগুলো একুশে টিভি অনলাইনের কাছে ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। করোনা ভাইরাসের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থেকে তারা যে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা তুলে ধরা হল-
১. জাককানইবি:
করোনার মতো একটি ভয়াবহ ব্যাধির জন্য থমকে গেছে পুরো দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা আটকে গেছে বলে মনে করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাত্ত্বিক মাহবুব। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন সকালের ক্লাস থেকে শুরু করে, রাজনীতি, বিতর্ক, আড্ডা, গান সব কিছু নিয়ে একটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই প্রতিটা দিন কেটে যেত। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সব কিছু থেকে নিজেকে একটি বদ্ধ পরিবেশে রাখতে হচ্ছে। বন্দী সময়টা মূলত পড়াশোনা, অনলাইনে ক্লাস করা, মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করা, চাকরির জন্য টুকটাক পড়াশোনা এবং একুরিয়ামে মাছ পালন সহ অনলাইনে বিতর্ক করার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের দ্বারা প্রতিনিয়ত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। এটি নতুন কোন ঘটনা নয়। এমন একটি অবস্থায় হতাশাগ্রস্ত না হয়ে বরং সুন্দর একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়াটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
২. ঢাবি: ক্যাম্পাস জীবনের সবচেয়ে বড় ছুটিতে বিরক্ত হয়ে ৯৩দিন পর ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনারুল ইসলাম। তিনি জানান, করোনার কারণে হাজারের অধিক শিক্ষার্থীর আবাসস্থল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল যেন জনশূন্য জমিদার বাড়ির মতো পরে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন সকাল-সন্ধ্যে ব্যস্ততায় সময় কাটাতাম। স্যাডোর দোকানে হালকা নাস্তা খেয়ে ৮ টার ক্লাস ধরতাম। ক্লাসের মাঝে ১ ঘন্টার বিরতিতে বন্ধুদের সাথে মলচত্বর, সামাজিক বিজ্ঞান চত্বর, উদ্যানের গেইট, টিএসসির বারান্দায় আড্ডা কিংবা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খেতাম। মাঝরাতে হলের বন্ধুরা মিলে ফুলার রোড,পলাশী,বুয়েট,শহীদ মিনার রোডে কোরাস গাইতে গাইতে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটা, ঢাকা মেডিকেলের সামনে মালাই চায়ের আড্ডা। করোনার জন্য এসব কিছুই থেমে গেছে। করোনার এই অবসর সময়ে একখন্ড জমিতে সমন্বিত ফসল চাষ করেছি। পেঁপে, পুইশাক, কচু, কুমড়ো, ঢেড়শ, মিষ্টিকুমড়া, শিম এবং কাঁকরোল ফলিয়েছি। পাশাপাশি প্রায় ১৫ জাতের ফলজ বৃক্ষ রোপণ করেছি। ছাগলের একটি খামার দেওয়ারও পরিকল্পনা করছি। করোনাকালীন অবসর সময়টা এগুলো করেই কাটাচ্ছি। তবুও মনের তাড়না, কবে ক্যাম্পাস খুলবে। আগের মতো সব স্বাভাবিক হবে। আবার স্বপ্ন বুনতে ফিরব ব্যস্ততার নগরীতে।
৩. রাবি: করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় পর থেকেই জীবনের স্বাভাবিক গতিটা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে বলে মনে করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো: হাবিবুল্লাহ। তিনি জানান, ক্যাম্পাসে থাকা কালীন দিনের বড় একটা অংশ ক্লাস, ল্যাব করেই কাটাতে হতো। পাশাপাশি ক্লাস টেস্ট, প্রেজেন্টেশন, বন্ধু দের সাথে হুটহাট আড্ডা, স্বননে আবৃত্তি চর্চা, মিলনায়তন, মুক্ত মঞ্চে কনসার্ট উপভোগ সব মিলে এক ব্যাস্ত তম দিন কাটতো । তবে অনার্স শেষ করে চাকরির জন্য পড়াশোনাও শুরু করেছিলাম, তখুনি যেন হঠাৎ সব থেমে গেলো। এখন করোনার কারণে পরিবারের সঙ্গে আছি। সময় কাটানোর জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কয়েক জন স্টুডেন্টকে পড়াচ্ছি, টুকটাক গল্পের বইও পড়ছি। লেখালেখির অভ্যাস থাকায় একটু লিখছিও। পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস গুলোরও একটু খোঁজ রাখছি। তার ওপর নেট খরচ, দূর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ও এলাকার বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি, নিজের জীবন সম্পর্কে বেশ ভাবাচ্ছে এখন। সব মিলিয়ে জীবনের স্বাভাবিক গতিটা করোনার কারণে বেশ স্থবির এখন। চাইছি দ্রুত এ সংকট কাটুক, একটা প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাস জীবন, একটা প্রত্যাশিত স্বাভাবিক জীবন আমার মতো সবাই পাক।
৪. বাকৃবি: ক্যাম্পাস খুললেও ব্ন্ধুদের সাথে আগের মতো সবাই একসাথে বসে আড্ডায় মেতে উঠতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহজনক মনোভাব পোষণ করছেন বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসমাত জাহান। তিনি জানান, করোনা ভাইরাস এক ধরনের মনুষ্য ভীতি সৃষ্টি করেছে। অথচ ক্যাম্পাস চলাকালীন সময়গুলোতে সারাদিন ক্লাস করে বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম। কোন দিন ব্রহ্মপুত্রে বুকে নৌকায় ঘুরতাম, রেল লাইনের ধারে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতাম, গল্প শেষে জব্বারের মোড়ে খাবার খেতাম। এ সবকিছু যেন যুগ যুগ আগের স্মৃতি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় বন্ধুদের আড্ডা, ঘোরাঘুরি বা হলের রঙিন জীবন সবকিছু গুটিয়ে নিজেকে বের করে এনে পরিবারের কাছাকাছি আবারো ফিরে এসেছি। এখন ঘরবন্দি হয়ে বাসার ছোটখাটো কাজগুলো করি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা দেই, গল্পের বই পড়ি, নতুন নতুন রান্নার রেসিপি শিখছি, মাঝে মাঝে ছবি আঁকি। চাকরি প্রস্তুতির সবচেয়ে ভাল সময় এখন হলেও বাসায় পড়ায় মন বসাতে খুব চেষ্টা করতে হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস না হওয়ায় এভাবেই অবসর সময়গুলো কাটিয়ে দিচ্ছি।
৫. হাবিপ্রবি: ঈদের পর ক্যাম্পাসের হল না খুললে মেস ভাড়া নিয়ে পড়াশুনা শুরু করবেন বলে ব্যতিক্রমধর্মী এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান। তিনি জানান, সারাদিন ক্যাম্পাসে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্র্যাকটিক্যাল, ল্যাবরেটরী সহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতাম। দিন শেষে হলে এসে পড়াশুনার পাশাপাশি রুমমেট দের সাথে আড্ডা একটু দিতাম। করোনা ভাইরাসের মত মহামারী এসে চোখের পলকে সব ব্যস্ততাকে থামিয়ে দিয়েছে। গত চার মাস ধরে বাসায় ঐ একই রুমে বসে সময়গুলো কাটাতে খুবই বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে গল্পের বই পড়ে সময় কাটিয়ে দেই। তবুও ঘরবন্দি থাকায় একাডেমিক পড়াশুনায় আগের মত মনোনিবেশ করতে পারছি না। তাই ঈদের পর করোনা ভাইরাসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে ক্যাম্পাসের পাশে মেস ভাড়া নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাবো।
৬. শাবিপ্রবি: ক্যাম্পাসের ব্যস্ততম কাটানো সময়গুলো মিস করেন বলেই কিছু দিন আগেও ক্যাম্পাস থেকে ঘুরে এসেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহাগ আলম চৌধুরী। তিনি জানান, করোনায় ঘরবন্দি থেকে জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে শহীদ মিনার চত্বর, লাল টং, গাজী কালুর মাজার সহ নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করতাম। একটু সময় পেলে খবরের কাগজ পড়তে চলে যেতাম কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের। এখন শুধু ঘরে বসে বাবা-মার সাথে গল্প গুজবের পাশাপাশি চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে সময় কাটাতে হয়। মাস্টার্সের দ্বিতীয় সেমিস্টারে এসে ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করছি। তবে গ্রামে নেটওয়ার্ক এর সমস্যা থাকায় ঠিকমতো ক্লাস করা অনেক কষ্টকর বিষয়। তাছাড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে একটি ইতিবাচক ফলাফল না আসলে আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল হবে না। এর ফলে সেশন জটে পড়ার একটি সম্ভাবনা আছে। সবকিছু মিলিয়ে করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
আরকে//